কক্সবাজারের 'হোপ ফাউন্ডেশন ফর উইমেন অব বাংলাদেশ' নামক একটি এনজিও সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত বেসরকারি হোপ হাসপাতালের বিরুদ্ধে স্বল্প খরচে সিজারের মাধ্যমে ডেলিভারির প্রলোভন দেখিয়ে এক প্রসূতির সাথে চরম অবহেলা, গাফিলতি ও ভুল চিকিৎসার অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি গত ২৫ শে এপ্রিল টেকনাফের নয়াপাড়া এলাকার নুরুল আজিম বাবুর স্ত্রী উম্মে নাসরিন সীমা (২৫) নরমাল ডেলিভারির জন্য হোপ হাসপাতালে ভর্তি হন।
২৬ এপ্রিল সিজার অপারেশন করেন ডাক্তার ফারহানা তানিম ও ডাক্তার নিন্ময় বিশ্বাস। অভিযোগ রয়েছে, অপারেশনের পর রোগীর প্রতি চরম অবহেলা, গাফিলতি ও ভুল চিকিৎসার কারণে মারাত্মক রক্তক্ষরণ হয়।
রোগী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কিছুদিন থাকার পরে বর্তমানে রোগীকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের ইনফেকশন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে । এছাড়া গুরুতর অভিযোগের ভিত্তিতে উক্ত হাসপাতালের বিরুদ্ধে তদন্তও শুরু হয়েছে বলে জানা যায়।
এনিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে সীমার স্বামী নুরুল আজিম বাবু কর্তৃক জেলা সিভিল সার্জন ও শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় বরাবর ১৩ মে ( সোমবার) অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
উক্ত অভিযোগে ভুক্তভোগী সীমার স্বামী বলেন, আমার স্ত্রী উম্মে নওরিন সীমা বিগত ২৫ এপ্রিল নরমাল ডেলিভারির জন্য রামুর চেইন্দাতে অবস্থিত হোপ ফাউন্ডেশনে নিয়ে যায়। সেখানে কোন চিকিৎসক না থাকায় মিডওয়াইফারি দ্বারা নরমাল ডেলিভারির চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
পরের দিন ডাক্তার উপস্থিত হয়ে স্ত্রীকে অতি দ্রুত অপারেশন করতে হবে বলে জানায়।
সেবা মূলক প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কেন একজন চিকিৎসক থাকে না? জানতে চাইলে উক্ত চিকিৎসক হুমকি প্রদর্শন পূর্বক আমার কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায়। সেখানে রোগীকে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গাল মন্দ করে, যা একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে কোনভাবে কাম্য নয়।
অপারেশন শেষে আমার স্ত্রীকে ৫-৬ ঘন্টা ধরে একটি অবজারভেশন রুমে রাখে। সেখানে পরিবারের কাওকে যেতে দেয়নি এমনকি কোন ডাক্তারও ছিল না। উক্ত সময়ে আমার স্ত্রী চটপট করলে নার্স দ্রুত ডাক্তারকে ডেকে আনে। ডাক্তার রোগীর অবনতি দেখে আমাদের দ্রুত কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আই.সি.ও তে নিয়ে যেতে বলে।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আই.সি.ও তে দুইদিন রেখে প্রায় ২০ ব্যাগ ব্লাড দেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন এবং আমরা তাৎক্ষনিক চট্টগ্রাম থেকে আই.সি.উ এম্বুলেন্স নিয়ে এসে রোগীকে ২৯ এপ্রিল রাত ৩ টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।
পরবর্তীতে চট্টগ্রামের বিশেষজ্ঞ গাইনী চিকিৎসকদল এটি আবার অপারেশন করতে বলে এবং অপারেশন করার পর ওখান থেকে ১.৫ লিটার ক্লথ ব্লাডসহ রোগীর (Uterus) জরায়ু কেটে পেলে।
পরবর্তীতে রোগীর (Cardiac Arrest) হলে, রোগীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আই.সি.ও তে প্রেরণ করে। ওখানে ৩ দিন আই.সি.ও তে থাকার পর গত ৯ মে রোগীকে বাড়িতে নিয়ে আসি।
উক্ত হোপ ফাউন্ডেশন হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাঃ তানিমের ভুল চিকিৎসার কারণে আমার স্ত্রীর ভবিষ্যত জীবন নষ্ট হয়ে গেছে এবং ৫ লাখের অধিক টাকা ব্যয় হয়।
আরও জানা যায়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছাড়পত্রে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, প্রথম অপারেশনের সময় ছোট ছোট গ্যাপ রাখার কারণে এবং সেলাই সঠিকভাবে না দেওয়ার কারণে রোগীর এমন অবস্থা হয়।
এছাড়া হোপ ফাউন্ডেশনের ভুল চিকিৎসা ও দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও গাফিলতির জন্যে উক্ত হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করার প্রক্রিয়াধীন বলে জানান সীমার স্বামী।
অভিযুক্ত হোপ ফাউন্ডেশনের ডাক্তার ফারহানা তানিমের সাথে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর মুঠোফোনের সংযোগ বিছিন্ন করে দিয়ে মুঠোফোন বন্ধ রাখেন। পরে হাসপাতালে গিয়েও পাওয়া যায়নি তাকে।
তবে অন্য অভিযুক্ত ডাক্তার নিন্ময় বিশ্বাসের কাছে জানতে চাইলে-রোগীর ব্লেডিং আমাদের হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাওয়ার পর হয়েছে বলে দাবি করেন।
একপর্যায়ে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আপনাদের অপারেশনে সেলাইগত ভুলের কারণে ব্লেডিং হয়েছে জানানো হয়েছে বলে জানালে তিনি সিজার অপরাশনে ছিলেন না বলে দায় এড়িয়ে প্রতিবেদকে হাসপাতালে আসার জন্য অনুরোধ করেন।
পরে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় কয়েকদিনের ছুটিতে তিনি হাসপাতালের বাইরে আছে।
হাসপাতালের চীফ মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ নুরুল ইসলাম নূর জানিয়েছেন অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করা হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এক পর্যায়ে তিনি স্বীকার করেন যে, হাসপাতালে যোগ্য ডাক্তারের অভাব রয়েছে এবং দ্রুত নিয়োগ দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেন।
হাসপাতালের কান্ট্রি পরিচালক জাহিদুর রহমান অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং সীমার পরিবারকে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর জন্য দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, হাসপাতালে কোনো ধরনের গাফিলতি বা ভুল চিকিৎসা করা হয়নি এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার ফাহমিদা সাথী জানান- সিজার অপারেশনের পর যথাযথ সেলাই না করার কারণে রোগীর ব্লেডিং শুরু হয়। বর্তমানে রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন।
যদিও বিষয়টি মানতে নারাজ হাসপাতালের কান্ট্রি ডিরেক্টর জাহিদূর রহমান।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডাঃ আসিফ আহমেদ হাওলাদার বলেন, এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে দ্রুত তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে এবং তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী বিধিসম্মতভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।