সমুদ্র-পাহাড়ের নৈসর্গিক টানে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে ছুটে আসে সারাদেশের মানুষ। তবে এই জেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত খারাপ হচ্ছে। শহর, শহরতলি এবং আশপাশের উপজেলায় প্রায় প্রতিদিনই হত্যা, অপহরণ, ছিনতাই, কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতের ঘটনা ঘটছে। গত ছয় মাসে জেলায় শুধু হত্যা মামলাই হয়েছে ৮৮টি। অপহরণের শিকার হয়েছে অর্ধশতেরও বেশি মানুষ। এ ছাড়া ছিনতাই ও ছুরিকাঘাতের ঘটনা অনেকটা সাধারণ হয়ে গেছে।
জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, কক্সবাজারে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত হত্যা, অপহরণ ও মানবপাচারের অভিযোগে ১০৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে খুনের মামলাই ৮৮টি। এ ছাড়া অপহরণ ও মানবপাচারের অভিযোগে মামলা হয়েছে ১৭টি। তাদের ভাষ্য, গরু চোরাচালান, মাদক, নারী ও জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে মূলত অপরাধমূলক এসব ঘটনা ঘটেছে।
সর্বশেষ গত রোববার কক্সবাজার-চট্টগ্রাম রেলপথের পাশে রামুর রশিদনগর এলাকায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আবদুল্লাহ আল মামুন (৩০) নামে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। স্বজনরা জানান, শনিবার সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হয়ে কক্সবাজার শহরের দিকে যান মামুন। এর পর তাঁর খোঁজ মেলেনি। পরদিন পাওয়া যায় লাশ।
এর আগে ৮ মে রামুর পাহাড়ি জনপদ গর্জনিয়া ইউনিয়নে আবুল কাশেম (৪০) নামে এক কৃষককে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁর ছোট ভাই শহীদুল্লাহ জানান, ৩০-৪০ জনের ডাকাত দল ভারী অস্ত্র নিয়ে তাঁর ভাইকে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। গরু পাচারে বাধা দেওয়ায় এ হত্যাকাণ্ড হয়।
এর আগে ২১ এপ্রিল গর্জনিয়া ইউনিয়নের থোয়াংগাকাটা ঘোনারপাড়া নামক এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে বাবা জাফর আলম (৫২) ও ছেলে মোহাম্মদ সেলিম (৩৩) নিহত হন। স্থানীয়রা জানান, বনভূমি দখল, চাঁদাবাজিসহ আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্থানীয় দুটি সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে কয়েক বছর ধরে গোলাগুলি, হামলা-পাল্টা হামলা চলে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় আবছার গ্রুপের প্রধান রোহিঙ্গা আবছারের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী বাবা-ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে সক্রিয় রয়েছে একাধিক চোরাচালান চক্র। মাদক ও বিভিন্ন পণ্যের পাশাপাশি সন্ধ্যা নামলেই ফুলতলীর পথ দিয়ে চোরাই গরু আনা হয়। এসব গরু রাখা হয় বিভিন্ন পাহাড় ও খামারে। চোরাচালানের এসব পণ্য ও পশু নিয়ে দ্বন্দ্বে প্রায়শ হচ্ছে খুনাখুনি।
অবশ্য অপরাধ কমাতে তৎপর থাকার দাবি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যদিও মাঠে তার প্রমাণ মিলছে না। সবশেষ জুন মাসেই বছরের সবচেয়ে বেশি ২২টি হত্যা মামলা হয়েছে। এর আগের মাস মে তে হয়েছে ২০টি। পুলিশ জানিয়েছে, হত্যা ও অপহরণের মামলায় অনেক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারিতে ১০ হত্যা মামলায় ৩২ আসামি এবং অপহরণ ও মানবপাচারের ৬ মামলায় ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ১৩ হত্যায় ৯ জন এবং অপহরণ ও মানবপাচারের ২ মামলায় ৬ আসামি, মার্চে ১০ হত্যায় ৩৫ এবং অপহরণ ও মানবপাচারের ৪ মামলায় ৯ আসামি, এপ্রিলে ১৩টি খুনের মামলায় ২৩ এবং অপহরণ ও মানবপাচারের ৪ মামলায় ৬ আসামি এবং মে মাসে ২০ হত্যায় ২৫ এবং অপহরণের ১ মামলায় ১ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এদিকে অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ জানিয়ে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্য ও কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, জেলায় প্রায় প্রতিদিনই খুনসহ নানা অপরাধ ঘটছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিকারের উপায় খুঁজে বের করা দরকার।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) রফিকুল ইসলাম বলেন, জমির বিরোধ এবং রোহিঙ্গাদের কারণে অপরাধের মাত্রা ও মামলার সংখ্যা বাড়ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক বিভিন্ন সংস্থা এ নিয়ে কাজ করছে। অপরাধ নির্মূলে এবং কক্সবাজারবাসীকে নিরাপদে রাখতে পুলিশ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে।