একবার–দুবার নয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের গাজায় অবিলম্বে ইসরায়েলি হামলা বন্ধ করতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তিনটি প্রস্তাবে ভোটে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। স্থায়ী সদস্যদেশ হওয়ায় মার্কিন ভেটোতে বাতিল হয়ে যায় গাজায় যুদ্ধবিরতির সেসব প্রস্তাব।
কিন্তু দৃশ্যপট বদলে যায় গতকাল সোমবার। গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে আবারও একটি প্রস্তাব তোলা হয়। সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রস্তাবে ভেটো দেওয়া থেকে বিরত ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
এর ফলে এবারই প্রথম জাতিসংঘের সর্বোচ্চ পর্ষদ নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান–সংবলিত প্রস্তাব পাস হলো।
জো বাইডেন প্রশাসনের ভেটো না দেওয়ার এমন নীতি নজিরবিহীন। বিশ্লেষকদের মতে, এর মধ্য দিয়ে গাজা নিয়ে ইসরায়েলের নেতৃত্বের প্রতি ওয়াশিংটনের ক্রমবর্ধমান হতাশা মনোযোগ কেড়েছে।
যদিও ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে থাকা ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতীকী কিংবা বাগাড়ম্বরপূর্ণ প্রচেষ্টা থেকে বেরিয়ে এসে ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন প্রশাসনের মৌলিক সমর্থনের বিষয়টি নতুন করে চিন্তাভাবনা করা দরকার।
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো না দেওয়ার প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অ্যাডাম শাপিরো বলেন, ‘এটা একটি পরিবর্তন। তবে এর ফলে ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ হয়নি। এরপরও এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।’
অবশ্য প্রস্তাবটি আইনিভাবে মেনে চলা ‘বাধ্যবাধকতা নয়’ বলছে ওয়াশিংটন। এর পরও তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি ইসরায়েলের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের আগে থেকে ঠিক থাকা ওয়াশিংটন সফর বাতিল করে দিয়েছেন।
নেতানিয়াহুর দপ্তর এক বিবৃতিতে প্রতিনিধিদলের সফর বাতিলের কথা জানিয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে, ইসরায়েলের যুদ্ধচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছে ওয়াশিংটন। এর মধ্য দিয়ে জো বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে নেতানিয়াহু সরকারের ক্রমশ বাড়তে থাকা দূরত্ব প্রকাশ হয়ে পড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকদের অনেকেরই প্রশ্ন, গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর কঠোর দমনপীড়ন বন্ধে ইসরায়েলের ওপর জো বাইডেন প্রশাসন চাপ প্রয়োগ করবে কিনা?
বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে ইসরায়েল সরকারের প্রতি গাজা উপত্যকায় বেসামরিক মানুষজনের সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি গাজায় আরও ত্রাণ বিতরণের সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
এ বিষয়ে ফিলিস্তিনি চিন্তক প্রতিষ্ঠান আল–শাবাকার মার্কিন নীতিবিষয়ক ফেলো তারিক কেনি–শাওয়া বলেন, গাজার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের নীতির আসল পরীক্ষা হলো, প্রতিশ্রুতি মেনে ইসরায়েলকে অস্ত্র দেবে কি না ওয়াশিংটন।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এখন ওয়াশিংটন সফরে রয়েছেন। উভয় দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, সফরকালে মার্কিন প্রশাসনের কাছে চলমান যুদ্ধের জন্য সুনির্দিষ্ট অস্ত্র চাইবেন তিনি।
আল–জাজিরাকে দেওয়া ই–মেইলে তারিক কেনি–শাওয়া আরও বলেন, ‘গাজায় হামলা চালিয়ে যেতে ইসরায়েল ও নেতানিয়াহুকে প্রযোজনীয় সব সরঞ্জাম দেওয়ার নীতি গত অক্টোবর থেকেই নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।’
তারিক কেনি–শাওয়া বলছেন, গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার জন্য ইসরায়েলকে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট পরিণতির মুখোমুখি হতে হয়নি।
আমাদের ভোটো না দেওয়া কখনোই, আমি আবারও বলছি, কখনোই আমাদের নীতি পরিবর্তনের প্রতিনিধিত্ব করে না।
জন কারবি, হোয়াইট হাইসের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মুখপাত্র
যা আছে প্রস্তাবে
৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামাসের হামলার মধ্য দিয়ে যুদ্ধের শুরু। ইসরায়েল ওই দিনই গাজায় পাল্টা হামলা করে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। কয়েক মাসের যুদ্ধে গাজায় ৩২ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। তাঁদের বেশির ভাগ নারী ও শিশু। বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখো ফিলিস্তিনি। অবরুদ্ধ গাজায় দেখা দিয়েছে চরম মানবিক সংকট।
গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে ইসরায়েলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ আগে থেকেই ছিল। তবে ভেটোর কারণে এর আগে নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাস হয়নি। তবে গতকালের প্রস্তাবটি নজিরবিহীনভাবে ১৪–০ ভোটে পাস হয়েছে। প্রস্তাবটিতে ভোট আর ভেটো—কোনোটিই দেননি জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত লিন্ডা টমাস–গ্রিনফিল্ড।
প্রস্তাবে গাজায় যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি অবিলম্বে ও নিঃশর্তভাবে হামাসের হাতে জিম্মি দশায় থাকা ব্যক্তিদের মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। সেই সঙ্গে গাজায় ত্রাণসহায়তা বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।
তাহলে কি গাজা নিয়ে নীতি বদলে ফেলছে যুক্তরাষ্ট্র? এমন প্রশ্ন অনেকের মনে। স্পষ্ট ভাষায় জবাব দিয়েছেন হোয়াইট হাইসের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মুখপাত্র জন কারবি। গতকাল সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমাদের ভেটো না দেওয়া কখনোই, আমি আবারও বলছি, কখনোই আমাদের নীতি পরিবর্তনের প্রতিনিধিত্ব করে না।’
জন কারবি আরও বলেন, ‘আমাদের অবস্থান সুস্পষ্ট। আমরা জিম্মি মুক্তির চুক্তির অংশ হিসেবে যুদ্ধবিরতির পক্ষে বরাবর নিজেদের সমর্থন জানিয়ে এসেছি।’
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের এমন অবস্থানকে ভিন্নভাবে দেখছেন নেতানিয়াহু। বিবৃতিতে নেতানিয়াহুর দপ্তর জানিয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটি পাস হওয়া ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ব্যর্থতা’ মার্কিন প্রশাসনের আগের অবস্থান থেকে ‘স্পষ্টত সরে আসার’ উদাহরণ।
নেতানিয়াহুর মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো না দেওয়ার ঘটনা হামাসের বিরুদ্ধে চলমান ইসরায়েলি যুদ্ধচেষ্টার পাশাপাশি হামাসের হাতে থাকা ১৩০ জনের বেশি জিম্মিকে মুক্ত করার চেষ্টাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
আর এর প্রতিক্রিয়ায় নেতানিয়াহু তাঁর দেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের পূর্বনির্ধারিত ওয়াশিংটন সফর বাতিল করেছেন। গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফায় সম্ভাব্য ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে দেশটির প্রতিনিধিদলের ওয়াশিংটন সফর করার কথা ছিল।
নিরাপত্তা পরিষদের ভোটাভুটির আগেই ইসরায়েল জানিয়ে দিয়েছিল, যদি জো বাইডেন প্রশাসন ভেটো দেওয়া থেকে বিরত থাকে, তাহলে তারা তাদের প্রতিনিধিদলকে ওয়াশিংটনে পাঠাবে না।
রাফায় পুরোদমে সামরিক অভিযান শুরু না করতে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ওয়াশিংটন।
মার্কিন প্রশাসন সতর্ক করে বলেছে, রাফায় অভিযান বেসামরিক মানুষদের ব্যাপক প্রাণহানির কারণ হতে পারে। সেই সঙ্গে এ অভিযান পুরো বিশ্ব থেকে ইসরায়েলকে আরও বিচ্ছিন্ন করে তুলতে পারে।
এ পরিস্থিতিতে ইসরায়েলি প্রতিনিধিদলের ওয়াশিংটন সফর বাতিল হওয়াটা জো বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের হতাশ করেছে। গতকাল মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার সাংবাদিকদের বলেন, সফর বাতিল করার বিষয়ে নেতানিয়াহুর সিদ্ধান্ত অবাক করা ও দুর্ভাগ্যজনক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অ্যাডাম শাপিরো বলেন, ‘এটা ইসরায়েলের পক্ষ থেকে জো বাইডেনের গালে চড় মারার সমান।’
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চিন্তক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির প্রেসিডেন্ট ন্যান্সি ওকাইল বলছেন, ‘এবারই প্রথম বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়াকে প্রকাশ্যে তোয়াক্কা করছেন না।’
ন্যান্সি ওকাইলের মতে, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো না দেওয়াটা তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এর ফলে নেতানিয়াহুর হুমকির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ওয়াশিংটন।
গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা, টেকসই শান্তি বজায় রাখা এবং ফিলিস্তিনিদের আরও মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের সমর্থন কতটা জোরালো, এখন সেটা দেখাতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে—এমনটাই বলছেন ন্যান্সি ওকাইল।
ন্যান্সি ওকাইলের মতে, এর অর্থ হলো, বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখা উচিত হবে কিনা, সেটা নতুন করে মূল্যায়ন করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অ্যাডাম শাপিরো বলেন, ‘বল এখন জো বাইডেন প্রশাসনের কোর্টে। মার্কিন প্রশাসনের সামনে কয়েকটি বিকল্প রয়েছে। সেখান থেকে তাদের একটি বেছে নিতে হবে।’