০৭:২৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
দ্য ওয়্যারের নিবন্ধ: ইজ নোবেল লোরিয়েট মুহাম্মদ ইউনূস এ প্রিজনার ইন ওয়েটিং?

প্রফেসর ইউনূস কী জেলে যাবেন নাকি ‘শয়তানের সঙ্গে সন্ধি করবেন’?

চীনের অর্থায়নে বানানো পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খায়েশ হয়েছিলো দেশের স্বনামধন্য দুই ব্যক্তিকে পদ্মার ঘোলাটে পানিতে চুবানোর। এদের মধ্যে প্রথমজন হলেন শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী এবং দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আর অপরজন হলেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়ার পেছনে ইউনূসের হাত রয়েছে বলে মনে করেন হাসিনা।

শেখ হাসিনা তার পানিতে চুবানোর খায়েশের অংশ হিসাবেই খালেদা জিয়াকে প্রথমে জেলে আটক করেছেন এরপর গৃহবন্দি করে রেখেছেন ৬ বছরের বেশি সময় ধরে। খালেদা জিয়ার এই কারাদণ্ডকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট। তাদের বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, “খালেদা জিয়াকে নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে রাখতেই এই সাজা দেওয়া হয়েছে।”

এবার শেখ হাসিনার জন্য সময় এসেছে প্রফেসর ইউনূসকে পানিতে চুবানোর খায়েশ পূরণ করার। সেই খায়েশ পূরণ করতে সব রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ড. ইউনূসকে হয়রানি এবং ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে। এই আশঙ্কাটা একেবারে যৌক্তিক। কারণ খালেদা জিয়াকে জেলে বন্দি করার আগে একই কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিলো।

সম্প্রতি জার্মানভিত্তিক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন সাইট অনলাইনকে দেওয়া সাক্ষাতকারে ড. ইউনূস বলেন, “আমি বাংলাদেশ ছেড়ে যাবোনা।” নিজ দেশে ভয়াবহ রকমের শঙ্কার কথা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “তারা আমাকে জেলে বন্দি করতে পারে।”

ক্ষুদ্র ঋণ এবং সামাজিক ব্যবসার পরিচিতির জন্য সকলের কাছে পরিচিত ৮৩ বছরের এই অর্থনীতিবিদ নিজের হয়রানির ঘটনার কথা স্মরণ করে ঐ সাক্ষাতকারে বলেন, কিছু লোক নিজেদের তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের লোক হিসাবে পরিচয় দিয়ে এখন অন্যান্য প্রতিষ্ঠান দখল করে নিতে চাচ্ছে।

আক্ষেপ প্রকাশ করে ড. ইউনূস বলেন, সারা জীবন যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন সেগুলো এখন আক্রমণের শিকার এবং প্রতিদিন হয়রানি বাড়ছে।

১৩ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে ড. ইউনূস বলেন, সরকারের ইন্ধনে ঢাকার গ্রামীণ টেলিকম ভবনে তার প্রতিষ্ঠিত ৮ টি প্রতিষ্ঠান জোর পূর্বক দখলের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানসমূহে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলো দখলকারীরা। এ বিষয়ে পুলিশের সহায়তা চাওয়া হলে তারা কোনো সহযোগিতা করেনি।

ইউনূসের অপরাধটা কী?

শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে ইউনূসকে ছয় মাসের জেল দিয়েছে বাংলাদেশের একটি আদালত। গ্রামীণ টেলিকমের কর্মীদের কল্যাণ ফান্ড গঠনে ব্যর্থ হবার দায়ে তাকে এই সাজা দিয়েছে আদালত।

আদালতের এই রায়ের ন্যায্যাতার দিকে ইঙ্গিত করে ভারতের নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের বন্ধু প্রফেসর রেহমান সোবহান লিখেছেন, “গণতান্ত্রিক এবং আইনি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বড় ধরনের আক্রমণের অংশ হিসাবে বছরের পর বছর ধরে আদালতকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।”

বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া

ড. ইউনূসের প্রতি এই আক্রমণাত্মক আচরণ নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব অবগত কীনা সে প্রসঙ্গে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রশ্ন করা হয় মুখপাত্র স্টিফেন ডোজারিককে। জবাবে তিনি বলেন, “বিষয়টি সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট অবগত রয়েছি। আমাকে পুনরাবৃত্তি করে বলতেই হয়, বছরের পর বছর ধরে জাতিসংঘের একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসাবে কাজ করে যাচ্ছেন ড. ইউনূস।”

ডোজারিক বলেন, “জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে দূত হিসাবে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। ড. ইউনূসকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যেসকল ঘটনা ঘটছে তা আমাদের চরমভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলছে।”

ড. ইউনূসের ওপর অব্যাহত হয়রানির বিরুদ্ধে সতর্ক সুরে একইভাবে উদ্বেগ জানিয়েছে স্টেট ডিপার্টমেন্ট।

স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রধান মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, “আমরা অন্যান্য আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের সাথে উদ্বিগ্ন যে এই মামলাগুলি ড. ইউনূসকে হয়রানি ও ভীতি প্রদশর্নের জন্য বাংলাদেশের শ্রম আইনের অপব্যবহার হতে পারে।”

তিনি বলেন, “আমরা উদ্বিগ্ন যে, শ্রম এবং দুর্নীতিবিরোধী আইনের এই অপব্যবহার আইনের শাসনকে বাধাগ্রস্ত করার সাথে সাথে ভবিষ্যতে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগকেও বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বিচার প্রক্রিয়া চলমান থাকায় আমরা ড. ইউনূসের জন্য একটি ন্যায্য ও স্বচ্ছ আইনি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”

ড. ইউনূসকে টার্গেট করে অবিচার করা হচ্ছে, এ কথা উল্লেখ করে একের পর এক উন্মুক্ত চিঠি লিখেছেন বিশ্ব নেতারা। চিঠিতে তারা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর উদ্বেগ এবং ন্যায় বিচারের আহ্বান তুলে ধরেছেন। সর্বশেষ জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অব্যাহত বিচারিক হয়রানি এবং জেলে বন্দি করার আশঙ্কা নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে চিঠি লিখেছেন ১২৫ নোবেল বিজয়ীসহ ২৪২ বিশ্ব নেতা।

অন্যদিকে, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অব্যাহত বিচারিক হয়রানি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে হাসিনাকে চিঠি পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই দলের  ১২ সিনেটর। বিগত এক দশকে ইউনূসের বিরুদ্ধে ১৫০টিরও বেশী বানোয়াট মামলা, বিচার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম এবং ফৌজদারি মামলার অপব্যবহার নিয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা চিঠিতে তুলে ধরেছেন সিনেটররা।

কেন ইউনূসকে টার্গেট করা হলো?

বিগত কয়েক বছর ধরে প্রফেসর ইউনূসের বিরুদ্ধে চরম প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছেন হাসিনা। তিনি ড. ইউনূসকে ‘রক্তচোষা,’ ‘সুদখোর’ এবং বিভিন্ন কটুবাক্যে আক্রমণ করে যাচ্ছেন।

সমালোচকদের কেউ কেউ বলছেন যে, হাসিনার তাঁর ওপর নিজের ক্রোধের বর্হিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন এই কারণে যে সারাবিশ্বে ড. ইউনূসের খ্যাতি শেখ হাসিনা এবং তাঁর বাবা শেখ মুজিবুর রহমানেকেও ছাড়িয়ে গেছে । অনেকে এটাও মনে করে আশ্চর্য হন যে, হাসিনা নোবেল পুরস্কার না পাওয়াটাই ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আক্রোশের মূল কারণ। কারণ হাসিনার তোষামোদকারীরা এটা বলে থাকেন যে, নোবেল পুরস্কার পাবার জন্য ইউনূসের চাইতে বেশী যোগ্য হাসিনা।

যদি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিই শেখ হাসিনার অভিষ্ট লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে ২০২১ সালে রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারর্স এর দেওয়া ‘গণমাধ্যম স্বাধীনতার শিকারি’ তকমা নিয়ে তাঁর খুশি থাকা উচিত!

গত ৮ জানুয়ারি, জালিয়াতির নির্বাচনে জয় লাভের ঠিক পরদিন, ভারতের এক সাংবাদিক হাসিনাকে প্রশ্ন করেন যে, বিনয় প্রকাশের বর্হিঃপ্রকাশ হিসাবে ড.  ইউনূসকে তিনি ক্ষমা করে দিবেন কীনা?

জবাবে হাসিনা বলেন, “এটা শ্রম আদালতের বিষয়। তাঁর নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা বঞ্চিত হয়েছে। আমার এখানে কিছু করার সুযোগ নেই। তাঁকে ক্ষমা করার বিষয়টি আমাকে বলা ঠিক নয়। বরং তাঁর উচিত শ্রমিকদের কাছে ক্ষমা চাওয়া।”

অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা, চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের দমন– এসবের বিরুদ্ধে ড. ইউনূস কোনো বলিষ্ট প্রতিবাদী কণ্ঠ নন।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে কেনো সোচ্চার হচ্ছেননা, ডয়চে ভেলে বাংলার এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস জানান, সরকারের অপ্রত্যাশিত আচরণ এড়াতেই তিনি এমনটা করেছেন।

এদিকে, বিতর্কিত কারাদণ্ডের পর গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলতে দেখা যায় ড. ইউনূসকে।

সম্প্রতি সিএনএন’র ক্রিস্টিয়ান আমানপোরকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে ড. ইউনূসের মেয়ে মনিকা ইউনূস  বলেছেন যে, তাঁর বাবা একসময় হাসিনার সাথে কাজ করেছেন। ভবিষ্যতে এরকম সুযোগ আবার পেলে তা গ্রহণ করবেন কীনা, ডয়চে ভেলে সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাব সরাসরি নাকোচ করেননি এই নোবেল বিজয়ী।

জবাবে ড. ইউনূস বলেন, “(এক সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে) আমি কী এতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি? এনিয়ে কেউ আমাকে কিছু বলেনি আর অন্যদিকে আমিতো তাঁর চোখে (শেখ হাসিনা) খুব খারাপ একজন লোক। ‘রক্তচোষা,’ ‘ডাকাত’ বলে অবিরত গালি দিয়েই যাচ্ছেন। আমাকে গালি না দিলে তিনি তৃপ্ত হননা।”

যদি আবার হাসিনার সাথে একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ পান ড. ইউনূস, তবে কী মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়াবার জন্য তাঁর দেয়া আহবানের সাথে তিনি আপোষ করবেন? জেলে যাওয়া এড়াতে শেখ হাসিনার সঙ্গে হাত মেলানো ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা কী তার জন্য খোলা রয়েছে? এই কারাবরণ এড়াতে ‘শয়তানের সঙ্গে সন্ধি’ ছাড়া সম্ভবত প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের খুব কম পথই খোলা রয়েছে।

ট্যাগ :
পাঠকপ্রিয়

আলুর দাম আরও বেড়েছে, স্বস্তি নেই ডিম-সবজিতেও

দ্য ওয়্যারের নিবন্ধ: ইজ নোবেল লোরিয়েট মুহাম্মদ ইউনূস এ প্রিজনার ইন ওয়েটিং?

প্রফেসর ইউনূস কী জেলে যাবেন নাকি ‘শয়তানের সঙ্গে সন্ধি করবেন’?

প্রকাশিত সময় : ০৯:২৯:২৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন ২০২৪

চীনের অর্থায়নে বানানো পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খায়েশ হয়েছিলো দেশের স্বনামধন্য দুই ব্যক্তিকে পদ্মার ঘোলাটে পানিতে চুবানোর। এদের মধ্যে প্রথমজন হলেন শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী এবং দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আর অপরজন হলেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়ার পেছনে ইউনূসের হাত রয়েছে বলে মনে করেন হাসিনা।

শেখ হাসিনা তার পানিতে চুবানোর খায়েশের অংশ হিসাবেই খালেদা জিয়াকে প্রথমে জেলে আটক করেছেন এরপর গৃহবন্দি করে রেখেছেন ৬ বছরের বেশি সময় ধরে। খালেদা জিয়ার এই কারাদণ্ডকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট। তাদের বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, “খালেদা জিয়াকে নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে রাখতেই এই সাজা দেওয়া হয়েছে।”

এবার শেখ হাসিনার জন্য সময় এসেছে প্রফেসর ইউনূসকে পানিতে চুবানোর খায়েশ পূরণ করার। সেই খায়েশ পূরণ করতে সব রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ড. ইউনূসকে হয়রানি এবং ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে। এই আশঙ্কাটা একেবারে যৌক্তিক। কারণ খালেদা জিয়াকে জেলে বন্দি করার আগে একই কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিলো।

সম্প্রতি জার্মানভিত্তিক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন সাইট অনলাইনকে দেওয়া সাক্ষাতকারে ড. ইউনূস বলেন, “আমি বাংলাদেশ ছেড়ে যাবোনা।” নিজ দেশে ভয়াবহ রকমের শঙ্কার কথা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “তারা আমাকে জেলে বন্দি করতে পারে।”

ক্ষুদ্র ঋণ এবং সামাজিক ব্যবসার পরিচিতির জন্য সকলের কাছে পরিচিত ৮৩ বছরের এই অর্থনীতিবিদ নিজের হয়রানির ঘটনার কথা স্মরণ করে ঐ সাক্ষাতকারে বলেন, কিছু লোক নিজেদের তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের লোক হিসাবে পরিচয় দিয়ে এখন অন্যান্য প্রতিষ্ঠান দখল করে নিতে চাচ্ছে।

আক্ষেপ প্রকাশ করে ড. ইউনূস বলেন, সারা জীবন যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন সেগুলো এখন আক্রমণের শিকার এবং প্রতিদিন হয়রানি বাড়ছে।

১৩ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে ড. ইউনূস বলেন, সরকারের ইন্ধনে ঢাকার গ্রামীণ টেলিকম ভবনে তার প্রতিষ্ঠিত ৮ টি প্রতিষ্ঠান জোর পূর্বক দখলের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানসমূহে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলো দখলকারীরা। এ বিষয়ে পুলিশের সহায়তা চাওয়া হলে তারা কোনো সহযোগিতা করেনি।

ইউনূসের অপরাধটা কী?

শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে ইউনূসকে ছয় মাসের জেল দিয়েছে বাংলাদেশের একটি আদালত। গ্রামীণ টেলিকমের কর্মীদের কল্যাণ ফান্ড গঠনে ব্যর্থ হবার দায়ে তাকে এই সাজা দিয়েছে আদালত।

আদালতের এই রায়ের ন্যায্যাতার দিকে ইঙ্গিত করে ভারতের নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের বন্ধু প্রফেসর রেহমান সোবহান লিখেছেন, “গণতান্ত্রিক এবং আইনি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বড় ধরনের আক্রমণের অংশ হিসাবে বছরের পর বছর ধরে আদালতকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।”

বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া

ড. ইউনূসের প্রতি এই আক্রমণাত্মক আচরণ নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব অবগত কীনা সে প্রসঙ্গে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রশ্ন করা হয় মুখপাত্র স্টিফেন ডোজারিককে। জবাবে তিনি বলেন, “বিষয়টি সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট অবগত রয়েছি। আমাকে পুনরাবৃত্তি করে বলতেই হয়, বছরের পর বছর ধরে জাতিসংঘের একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসাবে কাজ করে যাচ্ছেন ড. ইউনূস।”

ডোজারিক বলেন, “জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে দূত হিসাবে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। ড. ইউনূসকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যেসকল ঘটনা ঘটছে তা আমাদের চরমভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলছে।”

ড. ইউনূসের ওপর অব্যাহত হয়রানির বিরুদ্ধে সতর্ক সুরে একইভাবে উদ্বেগ জানিয়েছে স্টেট ডিপার্টমেন্ট।

স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রধান মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, “আমরা অন্যান্য আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের সাথে উদ্বিগ্ন যে এই মামলাগুলি ড. ইউনূসকে হয়রানি ও ভীতি প্রদশর্নের জন্য বাংলাদেশের শ্রম আইনের অপব্যবহার হতে পারে।”

তিনি বলেন, “আমরা উদ্বিগ্ন যে, শ্রম এবং দুর্নীতিবিরোধী আইনের এই অপব্যবহার আইনের শাসনকে বাধাগ্রস্ত করার সাথে সাথে ভবিষ্যতে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগকেও বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বিচার প্রক্রিয়া চলমান থাকায় আমরা ড. ইউনূসের জন্য একটি ন্যায্য ও স্বচ্ছ আইনি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”

ড. ইউনূসকে টার্গেট করে অবিচার করা হচ্ছে, এ কথা উল্লেখ করে একের পর এক উন্মুক্ত চিঠি লিখেছেন বিশ্ব নেতারা। চিঠিতে তারা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর উদ্বেগ এবং ন্যায় বিচারের আহ্বান তুলে ধরেছেন। সর্বশেষ জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অব্যাহত বিচারিক হয়রানি এবং জেলে বন্দি করার আশঙ্কা নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে চিঠি লিখেছেন ১২৫ নোবেল বিজয়ীসহ ২৪২ বিশ্ব নেতা।

অন্যদিকে, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অব্যাহত বিচারিক হয়রানি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে হাসিনাকে চিঠি পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই দলের  ১২ সিনেটর। বিগত এক দশকে ইউনূসের বিরুদ্ধে ১৫০টিরও বেশী বানোয়াট মামলা, বিচার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম এবং ফৌজদারি মামলার অপব্যবহার নিয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা চিঠিতে তুলে ধরেছেন সিনেটররা।

কেন ইউনূসকে টার্গেট করা হলো?

বিগত কয়েক বছর ধরে প্রফেসর ইউনূসের বিরুদ্ধে চরম প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছেন হাসিনা। তিনি ড. ইউনূসকে ‘রক্তচোষা,’ ‘সুদখোর’ এবং বিভিন্ন কটুবাক্যে আক্রমণ করে যাচ্ছেন।

সমালোচকদের কেউ কেউ বলছেন যে, হাসিনার তাঁর ওপর নিজের ক্রোধের বর্হিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন এই কারণে যে সারাবিশ্বে ড. ইউনূসের খ্যাতি শেখ হাসিনা এবং তাঁর বাবা শেখ মুজিবুর রহমানেকেও ছাড়িয়ে গেছে । অনেকে এটাও মনে করে আশ্চর্য হন যে, হাসিনা নোবেল পুরস্কার না পাওয়াটাই ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আক্রোশের মূল কারণ। কারণ হাসিনার তোষামোদকারীরা এটা বলে থাকেন যে, নোবেল পুরস্কার পাবার জন্য ইউনূসের চাইতে বেশী যোগ্য হাসিনা।

যদি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিই শেখ হাসিনার অভিষ্ট লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে ২০২১ সালে রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারর্স এর দেওয়া ‘গণমাধ্যম স্বাধীনতার শিকারি’ তকমা নিয়ে তাঁর খুশি থাকা উচিত!

গত ৮ জানুয়ারি, জালিয়াতির নির্বাচনে জয় লাভের ঠিক পরদিন, ভারতের এক সাংবাদিক হাসিনাকে প্রশ্ন করেন যে, বিনয় প্রকাশের বর্হিঃপ্রকাশ হিসাবে ড.  ইউনূসকে তিনি ক্ষমা করে দিবেন কীনা?

জবাবে হাসিনা বলেন, “এটা শ্রম আদালতের বিষয়। তাঁর নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা বঞ্চিত হয়েছে। আমার এখানে কিছু করার সুযোগ নেই। তাঁকে ক্ষমা করার বিষয়টি আমাকে বলা ঠিক নয়। বরং তাঁর উচিত শ্রমিকদের কাছে ক্ষমা চাওয়া।”

অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা, চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের দমন– এসবের বিরুদ্ধে ড. ইউনূস কোনো বলিষ্ট প্রতিবাদী কণ্ঠ নন।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে কেনো সোচ্চার হচ্ছেননা, ডয়চে ভেলে বাংলার এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস জানান, সরকারের অপ্রত্যাশিত আচরণ এড়াতেই তিনি এমনটা করেছেন।

এদিকে, বিতর্কিত কারাদণ্ডের পর গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলতে দেখা যায় ড. ইউনূসকে।

সম্প্রতি সিএনএন’র ক্রিস্টিয়ান আমানপোরকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে ড. ইউনূসের মেয়ে মনিকা ইউনূস  বলেছেন যে, তাঁর বাবা একসময় হাসিনার সাথে কাজ করেছেন। ভবিষ্যতে এরকম সুযোগ আবার পেলে তা গ্রহণ করবেন কীনা, ডয়চে ভেলে সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাব সরাসরি নাকোচ করেননি এই নোবেল বিজয়ী।

জবাবে ড. ইউনূস বলেন, “(এক সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে) আমি কী এতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি? এনিয়ে কেউ আমাকে কিছু বলেনি আর অন্যদিকে আমিতো তাঁর চোখে (শেখ হাসিনা) খুব খারাপ একজন লোক। ‘রক্তচোষা,’ ‘ডাকাত’ বলে অবিরত গালি দিয়েই যাচ্ছেন। আমাকে গালি না দিলে তিনি তৃপ্ত হননা।”

যদি আবার হাসিনার সাথে একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ পান ড. ইউনূস, তবে কী মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়াবার জন্য তাঁর দেয়া আহবানের সাথে তিনি আপোষ করবেন? জেলে যাওয়া এড়াতে শেখ হাসিনার সঙ্গে হাত মেলানো ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা কী তার জন্য খোলা রয়েছে? এই কারাবরণ এড়াতে ‘শয়তানের সঙ্গে সন্ধি’ ছাড়া সম্ভবত প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের খুব কম পথই খোলা রয়েছে।