চলতি পর্যটন মৌসুমের বড় অংশ কেটেছে পর্যটক খরায়। জাতীয় নির্বাচন ও ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এ মৌসুমে পর্যটন খাত ছিল বিশাল ক্ষতির মুখোমুখি। পর্যটকশূন্যতার এই মন্দা কাটতে শুরু করে জানুয়ারির শেষের দিক থেকে। কক্সবাজারমুখী হতে শুরু করেন পর্যটকেরা।
গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে মিয়ানমারের রাখাইনে সংঘাতের কারণে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে ছেদ পড়ে। অধিকাংশ পর্যটক পছন্দের সেন্ট মার্টিনে যেতে না পেরে অতৃপ্ত মনে কক্সবাজার ছাড়েন। নাফ নদীর সীমান্তে নিরাপত্তা বিবেচনায় ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌরুটে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় এবার পর্যটকেরা সেন্ট মার্টিন ভ্রমণের সুযোগ পাননি। তারপরও মাস দেড়েক কক্সবাজার শহর ও আশপাশের পর্যটনকেন্দ্রে ভরপুর পর্যটক ছিল। হইহুল্লোড়-উচ্ছ্বাসের সেই সমুদ্রসৈকতে এখন চলছে সুনসান নীরবতা।
এবার ঈদের ছুটির সঙ্গে পড়ছে পয়লা বৈশাখ। এ সময়ে ৭ থেকে ৮ দিনের ছুটিতে কক্সবাজারে বিপুলসংখ্যক পর্যটক আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এর মধ্যে পর্যটকনির্ভর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও সংস্কারমূলক কাজ চালানো হচ্ছে। অনেক হোটেল-রেস্তোরাঁয় অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় কাজ সারানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে ঈদের পরে মাসখানেক পর্যটকের আনাগোনা বাড়বে বলে আশা করেন পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। ফলে পর্যটক বরণে ব্যবসায়ীদের নানা উদ্যোগ শুরু হয়েছে।
কক্সবাজার শহরের সুগন্ধা পয়েন্ট সমুদ্রসৈকত ভোর থেকে রাত পর্যন্ত মুখর থাকে পর্যটকদের আনাগোনায়। সম্প্রতি সৈকতে গিয়ে দেখা যায় অনেকটাই ফাঁকা। হাতে গোনা কিছু পর্যটক বালিয়াড়িতে পাতানো কিটকটে (চেয়ার-ছাতা) বসে সময় কাটাচ্ছেন। সাগর দাপিয়ে বেড়ানো ওয়াটারবাইক ও বালিয়াড়ি চষে বেড়ানো বিচবাইকেরও দেখা নেই। এদিক-ওদিক কয়েকটি ঘোড়া পর্যটকের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাশের সি গাল, লাবণি ও কলাতলী পয়েন্ট একেবারেই ফাঁকা।
ফাঁকা কক্সবাজারে পর্যটক টানতে হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টের কক্ষ ভাড়ায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিয়েও সাড়া মিলছে না। ৯৫ শতাংশ কক্ষই খালি পড়ে আছে। পর্যটন জোনের অধিকাংশ রেস্তোরাঁ পর্যটকশূন্যতায় বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে পর্যটকনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্যের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এই এক মাস ছুটি দেওয়া হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সমুদ্রে গোসলে নামা পর্যটকদের নিরাপত্তায় কাজ করা সি সেফ লাইফগার্ডের তিন উদ্ধারকর্মী সুগন্ধা পয়েন্টে অলস সময় কাটাচ্ছেন। তাঁদের একজন শিমুল ত্রিপুরা। তাঁর নজর আছড়ে পড়া সাগরের ঢেউয়ের দিকে। শিমুল জানালেন, সব সময় সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়। কেউ একজন গোসলে নেমে যদি সাগরে তলিয়ে যায়!
উদ্ধারকর্মীর মতো সৈকতের ফটোগ্রাফার, হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অলস সময় পার করছেন। সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টের দোকানপাটও বন্ধ দেখা গেছে। জেলা প্রশাসনের তথ্যসেবা ও অভিযোগকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা বিচকর্মী বেলাল হোসেন বলেন, হাতে গোনা পর্যটক নামছেন সৈকতে। যাঁরা আসছেন, তাঁদের বেশির ভাগই স্থানীয়। এতে তথ্যসেবা কেন্দ্রে খুব একটা চাপ নেই।
রংপুর থেকে ছয় বন্ধু কক্সবাজারে ঘুরতে এসেছেন। প্রায় প্রতিবছর তাঁরা আসেন ঘুরতে। এবার তিন-চার দিন ঘোরার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান পর্যটক মোশাররফ হোসেন ও অজিত বসু। তাঁরা জানান, এবার ট্রেনে কক্সবাজার আসতে পেরে ভ্রমণটা অন্য রকম আনন্দ জুগিয়েছে। হোটেলের কক্ষ ভাড়ায় বড় ছাড় পেয়েছেন বলেও জানান তাঁরা। মোশাররফ বলেন, ‘পর্যটক কম থাকায় নিরিবিলি পরিবেশ ভালোই উপভোগ করছি। তবে খাবারদাবারে একটু সমস্যা পোহাতে হচ্ছে।’
শহরের পর্যটন জোনে পাঁচ শতাধিক হোটেল, রিসোর্ট, গেস্টহাউস ও কটেজের ৯৫ শতাংশ কক্ষ খালি পড়ে আছে। রোজার প্রথম দিন থেকে চার শতাধিক রেস্তোরাঁও বন্ধ রয়েছে। সৈকতে তারকা মানের হোটেল কক্স টুডে। এই হোটেলে কক্ষ আছে ১৭০টি। হোটেলটির জেনারেল ম্যানেজার (রিজার্ভেশন) আবু তালেব শাহ। তিনি বলেন, ‘পর্যটক নেই বললেই চলে। যাঁরা আসছেন, তাঁদের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে হোটেলের সংস্কারকাজও চলছে।’ ঈদ ও বাংলা নববর্ষে পর্যটক সমাগমের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
একই অবস্থা শহরের অভিজাত হোটেল ওশান প্যারাডাইস, সায়মন রিসোর্ট, সি গাল, লং বিচ, সি প্যালেস, হোটেল কল্লোল, রয়েল রিসোর্টসহ মাঝারি হোটেল ও রিসোর্টগুলোর। অনেক হোটেল একেবারেই পর্যটকশূন্য বলে জানা গেছে।
শহরের একটি ট্যুর অপারেটরের পরিচালক সাইফুল আলম জানান, কক্সবাজারে ট্রেন চলাচলের কারণে হাজারখানেক নিয়মিত পর্যটক আসছেন। ঈদ ও বাংলা নববর্ষের ছুটি উপলক্ষে এখন থেকেই হোটেল বুকিং দিচ্ছেন পর্যটকেরা। এ সময় ব্যবসায়ীরা পর্যটকদের বরণে নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের চেষ্টা করছেন এবং বিভিন্ন অফার দিচ্ছেন।
কক্সবাজার হোটেল, রিসোর্ট গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার বলেন, এখন হোটেল-রেস্তোরাঁর সংস্কারকাজ চলছে। এর মধ্যে কর্মচারীদের একটি বড় অংশকে ঈদের অগ্রিম বেতন-বোনাস দিয়ে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘রোজা শেষে ঈদুল ফিতর ও নববর্ষের টানা ৭ থেকে ৮ দিনের ছুটিতে ব্যাপক পর্যটক সমাগম হবে। তখন পর্যটকনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্যেও চাঙাভাব দেখা দেবে। এ জন্য পর্যটন ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন।’
আবুল কাসেম সিকদার জানান, পর্যটক টানতে রোজার মাসে হোটেল-রিসোর্ট ও গেস্টহাউসের কক্ষ ভাড়ায় সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়েছে। ঈদ পর্যন্ত এ ছাড় চলবে।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার অঞ্চলের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, ‘পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ট্যুরিস্ট পুলিশ সম্প্রতি নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া টানা ছুটি, বিশেষ দিনে বাড়তি টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়।’
ট্রেন চলাচল শুরুর পর থেকে পর্যটকের চাপ বেড়েছে বলে জানান কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান। তিনি বলেন, ‘পর্যটকদের সেবা ও ভ্রমণ নির্বিঘ্ন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে থাকবেন।’