০৭:৩৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বনভূমি উজাড় করে বসতি, হুমকিতে বন্যপ্রাণী

  • প্রতিনিধির নাম
  • প্রকাশিত সময় : ০৭:১৬:১৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ মার্চ ২০২৪
  • ১০৮ ভিউ

আজ ২১ মার্চ বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক বন দিবস। দিবসটি ঘিরে উঠে এসেছে কক্সবাজারে বনাঞ্চল ধ্বংসের ভয়াবহ চিত্র। বিশেষ করে গত পাঁচ বছরে উখিয়া—টেকনাফে ধ্বংস হয়েছে প্রায় ১২ হাজার একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে ধ্বংস হয় এই বনভূমি।

এছাড়া এশিয়ান প্রজাতির হাতির অন্যতম আবাসস্থল ছিল উখিয়া টেকনাফের বনভূমি। বনভূমি উজাড় হওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে বন্যহাতি। নির্বিচারে বনভূমি উজাড় হওয়ায় খাদ্যের অভাবে প্রতি বছর লোকালয়ে হানা দিচ্ছে বন্যহাতি পাল। এতে হাতি যেমন মারা পড়ছে তেমনি মানুষসহ গবাদি পশুরও মৃত্যু ঘটছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উখিয়ার কুতুপালং মহাসড়কের পাশে টাঙানো রয়েছে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড— ‘বন্যহাতি চলাচলের পথ’। এর ঠিক পেছনেই ছোট বড় গাছপালা কেটে নির্মাণ করা হয়েছে শরণার্থী ক্যাম্প। উঁচু পাহাড়ের কোল কিংবা পাদদেশ পাহাড় কেটে থরে থরে নির্মাণ করা হয়েছে দুই লাখের বেশি অস্থায়ী ঘর। স্থাপন করা হয়েছে নলকূপ, পায়খানা, বিদ্যুৎলাইন, সড়ক, নিষ্কাশন খাল, সরকারি—বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কার্যালয়সহ গুদামঘর। জ্বালানির জন্য উজাড় হচ্ছে বন। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বন্যহাতির চলাচল ও বিচরণ ক্ষেত্র। এখন আর দেখে বোঝার উপায় নেই এসব পাহাড়ে পাঁচ বছর আগেও ছিল সবুজ অরণ্য এবং হাতির রাজত্ব।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য এ অঞ্চলের প্রায় ১২ হাজার ২০০ একর বনভূমি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। পাশাপাশি আরো তিন থেকে চার হাজার একর বনভূমির গাছপালা উজাড় হয়েছে রোহিঙ্গাদের জ্বালানি সংগ্রহের জন্য। এছাড়া কক্সবাজার ও টেকনাফের বিশাল পাহাড়ি বনভূমিতে ৫২৫ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া যেত। যা স্তন্যপায়ী বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। কিন্তু পাহাড়ে রোহিঙ্গা বসতির কারণে এসব এখন ধ্বংসের পথে। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা সরওয়ার আলম বলেন, ‘২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে থেকে দেশটির রোহিঙ্গারা উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, তেলখোলা মোছার খোলা, মক্করারবিল বা হাকিমপাড়া, জামতলী বাঘঘোনা, শফিউল্লা কাটা এবং টেকনাফের পুটিবুনিয়া উনচিপ্রাং ঝিমং খালী, রঙ্গিখালী, লেদা মোছনী ও জাদিমুড়া বন বিভাগের পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। এতে ধ্বংস হয়েছে ১২ হাজার ২০০ একর সামাজিক ও প্রাকৃতিক বন।’

পরিবেশবিদরা বলছেন, হাতি বৃহৎ বন্যপ্রাণী ও শক্তিধর হওয়ায় মানুষের কাছে প্রকৃতি বিনষ্টের প্রতিশোধ নিচ্ছে। হাতি ছাড়াও চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যান্য বন্যপ্রাণী, জীবজন্তু—পাখিসহ জীববৈচিত্র্য। বিনষ্ট হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, লতা, গুল্ম, বাঁশ, বেত, উলুফুল, ঔষধি গাছ। এসব ক্ষুদ্র বন্যপ্রাণী, জীবজন্তু ও গাছপালা হাতির মতো এ মুহূর্তে প্রতিশোধ না নিতে পারলেও অদূর ভবিষ্যতে তা আরো বেশি হুমকির কারণ হবে। পরিবেশের ওপর প্রভাববিষয়ক ইউএনডিপির এক গবেষণায় উঠে আসে, রোহিঙ্গা বসতির কারণে উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় মোট ১১ ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে— অতিরিক্ত সংখ্যক টিউবওয়েল স্থাপনের কারণে ভূ—গর্ভস্থ পানির আধার কমে যাওয়া, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভূ—গর্ভস্থ পানির আধার দূষিত হওয়া। সুপেয় পানির অন্যান্য উৎস যেমন— সীমিত সংখ্যক নদী ও খাল এরই মধ্যে দূষিত হয়েছে। এছাড়া অতিরিক্ত গাছ কাটা ও পাহাড় ধ্বংসের কারণে বেশিরভাগ পাহাড়ি ছড়া এখন সারাবছরই পানিশূন্য থাকছে। এতে করে ওই এলাকায় বসবাসকারী স্থানীয় জনগণ দীর্ঘমেয়াদে প্রাকৃতিক সুপেয় খাবার পানির অভাবে পড়তে যাচ্ছে। একইসঙ্গে অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে ১৩ লাখের ও বেশি রোহিঙ্গাসহ ১৭ লাখ অধিবাসীর এ অঞ্চল পরিণত হচ্ছে এক কঠিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে ভাগাড়ে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে উখিয়া ও টেকনাফের পরিবেশগত ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। রোহিঙ্গা আসার আগে সেখানে হাতির আবাসস্থল ছিল, সেখানে এখন রোহিঙ্গাদের বসবাস। যার ফলে জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে রয়েছে।’ ‘ধরা’ কক্সবাজারের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের জন্য বিশাল বনভূমি বরাদ্দ দেওয়ায় কক্সবাজারে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে রয়েছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে নির্বিচারে গাছ কাটা হয়েছে। ফলে সাগর, পাহাড় আর সবুজ বনাঞ্চলে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে।’

ট্যাগ :
পাঠকপ্রিয়

আলুর দাম আরও বেড়েছে, স্বস্তি নেই ডিম-সবজিতেও

বনভূমি উজাড় করে বসতি, হুমকিতে বন্যপ্রাণী

প্রকাশিত সময় : ০৭:১৬:১৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ মার্চ ২০২৪

আজ ২১ মার্চ বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক বন দিবস। দিবসটি ঘিরে উঠে এসেছে কক্সবাজারে বনাঞ্চল ধ্বংসের ভয়াবহ চিত্র। বিশেষ করে গত পাঁচ বছরে উখিয়া—টেকনাফে ধ্বংস হয়েছে প্রায় ১২ হাজার একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে ধ্বংস হয় এই বনভূমি।

এছাড়া এশিয়ান প্রজাতির হাতির অন্যতম আবাসস্থল ছিল উখিয়া টেকনাফের বনভূমি। বনভূমি উজাড় হওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে বন্যহাতি। নির্বিচারে বনভূমি উজাড় হওয়ায় খাদ্যের অভাবে প্রতি বছর লোকালয়ে হানা দিচ্ছে বন্যহাতি পাল। এতে হাতি যেমন মারা পড়ছে তেমনি মানুষসহ গবাদি পশুরও মৃত্যু ঘটছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উখিয়ার কুতুপালং মহাসড়কের পাশে টাঙানো রয়েছে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড— ‘বন্যহাতি চলাচলের পথ’। এর ঠিক পেছনেই ছোট বড় গাছপালা কেটে নির্মাণ করা হয়েছে শরণার্থী ক্যাম্প। উঁচু পাহাড়ের কোল কিংবা পাদদেশ পাহাড় কেটে থরে থরে নির্মাণ করা হয়েছে দুই লাখের বেশি অস্থায়ী ঘর। স্থাপন করা হয়েছে নলকূপ, পায়খানা, বিদ্যুৎলাইন, সড়ক, নিষ্কাশন খাল, সরকারি—বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কার্যালয়সহ গুদামঘর। জ্বালানির জন্য উজাড় হচ্ছে বন। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বন্যহাতির চলাচল ও বিচরণ ক্ষেত্র। এখন আর দেখে বোঝার উপায় নেই এসব পাহাড়ে পাঁচ বছর আগেও ছিল সবুজ অরণ্য এবং হাতির রাজত্ব।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য এ অঞ্চলের প্রায় ১২ হাজার ২০০ একর বনভূমি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। পাশাপাশি আরো তিন থেকে চার হাজার একর বনভূমির গাছপালা উজাড় হয়েছে রোহিঙ্গাদের জ্বালানি সংগ্রহের জন্য। এছাড়া কক্সবাজার ও টেকনাফের বিশাল পাহাড়ি বনভূমিতে ৫২৫ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া যেত। যা স্তন্যপায়ী বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। কিন্তু পাহাড়ে রোহিঙ্গা বসতির কারণে এসব এখন ধ্বংসের পথে। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা সরওয়ার আলম বলেন, ‘২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে থেকে দেশটির রোহিঙ্গারা উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, তেলখোলা মোছার খোলা, মক্করারবিল বা হাকিমপাড়া, জামতলী বাঘঘোনা, শফিউল্লা কাটা এবং টেকনাফের পুটিবুনিয়া উনচিপ্রাং ঝিমং খালী, রঙ্গিখালী, লেদা মোছনী ও জাদিমুড়া বন বিভাগের পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। এতে ধ্বংস হয়েছে ১২ হাজার ২০০ একর সামাজিক ও প্রাকৃতিক বন।’

পরিবেশবিদরা বলছেন, হাতি বৃহৎ বন্যপ্রাণী ও শক্তিধর হওয়ায় মানুষের কাছে প্রকৃতি বিনষ্টের প্রতিশোধ নিচ্ছে। হাতি ছাড়াও চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যান্য বন্যপ্রাণী, জীবজন্তু—পাখিসহ জীববৈচিত্র্য। বিনষ্ট হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, লতা, গুল্ম, বাঁশ, বেত, উলুফুল, ঔষধি গাছ। এসব ক্ষুদ্র বন্যপ্রাণী, জীবজন্তু ও গাছপালা হাতির মতো এ মুহূর্তে প্রতিশোধ না নিতে পারলেও অদূর ভবিষ্যতে তা আরো বেশি হুমকির কারণ হবে। পরিবেশের ওপর প্রভাববিষয়ক ইউএনডিপির এক গবেষণায় উঠে আসে, রোহিঙ্গা বসতির কারণে উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় মোট ১১ ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে— অতিরিক্ত সংখ্যক টিউবওয়েল স্থাপনের কারণে ভূ—গর্ভস্থ পানির আধার কমে যাওয়া, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভূ—গর্ভস্থ পানির আধার দূষিত হওয়া। সুপেয় পানির অন্যান্য উৎস যেমন— সীমিত সংখ্যক নদী ও খাল এরই মধ্যে দূষিত হয়েছে। এছাড়া অতিরিক্ত গাছ কাটা ও পাহাড় ধ্বংসের কারণে বেশিরভাগ পাহাড়ি ছড়া এখন সারাবছরই পানিশূন্য থাকছে। এতে করে ওই এলাকায় বসবাসকারী স্থানীয় জনগণ দীর্ঘমেয়াদে প্রাকৃতিক সুপেয় খাবার পানির অভাবে পড়তে যাচ্ছে। একইসঙ্গে অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে ১৩ লাখের ও বেশি রোহিঙ্গাসহ ১৭ লাখ অধিবাসীর এ অঞ্চল পরিণত হচ্ছে এক কঠিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে ভাগাড়ে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে উখিয়া ও টেকনাফের পরিবেশগত ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। রোহিঙ্গা আসার আগে সেখানে হাতির আবাসস্থল ছিল, সেখানে এখন রোহিঙ্গাদের বসবাস। যার ফলে জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে রয়েছে।’ ‘ধরা’ কক্সবাজারের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের জন্য বিশাল বনভূমি বরাদ্দ দেওয়ায় কক্সবাজারে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে রয়েছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে নির্বিচারে গাছ কাটা হয়েছে। ফলে সাগর, পাহাড় আর সবুজ বনাঞ্চলে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে।’