রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েকটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর পেছনে কারণ বের হয়ে আসে ভবনগুলোয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না রাখা বিষয়টি। পরে নড়েচড়ে বসে রাজধানীর সেবা সংস্থাগুলো। অভিযান চালিয়ে ভবন সিলগালা ও জরিমানা করা হয় ভবন মালিক ও দোকান মালিককে। কিন্তু কিছুদিন পরেই অজ্ঞাত কারণে থেমে যায় এসব অভিযান। সবকিছু আবার চলতে শুরু করে আগের মতো।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর সেখানে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা না থাকার বিষয়টি উঠে আসে। অগ্নিনীতিমালা না মেনেই বছরের পর বছর ভবনটিতে চলছিল রেস্তোরাঁর ব্যবসা। ৪৬ জনের প্রাণহানির পর এবারও নড়েচড়ে বসে সেবা সংস্থাগুলো। অনিয়ম-দুর্নীতি ও অপরাধী খুঁজতে একযোগে মাঠে নামে সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।
এ ঘটনার কারণে টানা কয়েক দিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার রেস্তোরাঁয় অভিযান চালায় টাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট। অগ্নি নীতিমালা না মানার অভিযোগ এনে এসব রেস্তোরাঁর মালিক কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট অনেকে গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ।
তবে শুধু রেস্তোরাঁর অভিযান পুলিশেই কেন সীমাবদ্ধ? আরও যেসব আবাসিক ভবন, বেসরকারি অফিস ভবন ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান; যেখানে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা মানছে না তারা; সেখানে কেন অভিযান চালানো হচ্ছে না, কেন অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের দায় সারছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, প্রশ্ন উঠছে এসব নিয়ে।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) রাত সাড়ে ১১টার দিকে ডেমরার ভাঙ্গা প্রেস এলাকায় চার তলা একটি ভবনের তিন তলায় আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট এসে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে শুক্রবার সকাল ৮টায় নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল নৌবাহিনীও।
আগুন নিয়ন্ত্রণের পর ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, কোনও ধরনের নীতিমালা না মেনে নির্মাণ করা হয়েছে ডেমরার ওই ভবন। সেখানে নেই ফায়ার এক্সিট, ভেতরে ঢোকার সিঁড়িও খুবই সংকীর্ণ। পাশের অন্য ভবন থেকে পানি দেওয়ার সুব্যবস্থাও নেই, কারণ সব ভবন লাগোয়া। ভবনটির নিচে নেই নিজস্ব কোনও পানির মজুত।
ফায়ার সার্ভিস আরও জানায়, ঘন ঘন বা লাগোয়া ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। যেটি এখন জ্বলছে, তার ঠিক পূর্ব পাশের ভবনটিও লাগোয়া। একই দেয়াল, এক ইঞ্চিও ফাঁকা নেই। যে কারণে ভবনটির পূর্ব পাশ দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে পানি দেওয়াসহ কোনও কাজই করা যাচ্ছিল না। ভবনটির নিচে যে ওয়াটার রিজার্ভ থাকার কথা ছিল, সেটি পাওয়া যায়নি। শুধু তা-ই নয়, এই আগুন লাগা ভবনের আশপাশে যেসব ভবন রয়েছে, সেখানেও পানির রিজার্ভ ছিল না। এসব কারণে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের।
এর আগে গত ১৪ মার্চ রাতে রাজধানীর হাতিরপুলের রাজ কমপ্লেক্স নামের ছয় তলা ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যা ৬টায় আগুন লাগলে টানা আড়াই ঘণ্টা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় ফায়ার সার্ভিসের ৭টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। অবশ্যই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আনতে আরও সময় নেয়।
ভবনটির আগুন নিয়ন্ত্রণে দেরি হওয়ার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, ভবনের ভেতরে ব্যাপক ধোঁয়া ছিল। এর দ্বিতীয় তলার একটি কার্পেটের গোডাউনে আগুন লাগে। চারপাশে কোনও জানালা না থাকার কারণে দেয়াল, জানালা ভাঙে ভেতরে ঢুকতে হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, রাজ কমপ্লেক্সের একটি মাত্র সিঁড়ি। কোনোরকম অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা ছাড়াই এখনও ব্যবহার করা হচ্ছে এটি। ভবনের নিচ ও দ্বিতীয় তলায় কার্পেটের গোডাউন রয়েছে। যেখানে আগুনের ছোঁয়া পেলে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রাজধানী বা সারা দেশে অগ্নিকাণ্ডের পর অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা না থাকার বিষয়টি বেশির ভাগ ভবনের ক্ষেত্রেই পাওয়া গেছে। তবে এসব চিহ্নিত হলেও তা বাস্তবায়নে যথেষ্ট অবহেলা রয়েছে। ফলে একের পর এক ঘটছে প্রাণঘাতী ঘটনা।
এর আগে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা, নিমতলী, গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজার ও বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ড কিংবা সায়েন্স ল্যাবে ভবনে বিস্ফোরণ; যখনই এমন ঘটনা ঘটেছে, সেবা সংস্থাগুলো একে অপরের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের দায় সেরেছে। বেইলি রোডের ঘটনার পরও দেখা গেছে একই চিত্র। কয়েক দিন টানা অভিযানের পর দু-একটি অভিযান ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনও অভিযানের খবর পাওয়া যাচ্ছে না।
পুলিশ বলছে, রেস্তোরাঁর বাইরে বহুতল আবাসিক ভবন, বিভিন্ন অফিসে অবৈধভাবে গ্যাসের সংযোগ রয়েছে। কিন্তু নেই অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা নেই। এসব দেখার প্রাথমিক দায়িত্ব পুলিশের নয়। এগুলো অন্য সংস্থাগুলোর কাজ। তারপরও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সহায়তা চাইলে সে ক্ষেত্রে পুলিশ সহায়তা করবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়লে হবে না, দীর্ঘদিনের অনিয়ম নিয়মের মধ্যে আনতে হবে।
ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বেইলি রোডের দুর্ঘটনার পর এ রকম যেসব ভবন অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ছিল, সেগুলোতে আমরা অভিযান চালিয়েছি। কিন্তু আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট কম থাকায় আরও যেসব ভবন বা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানো দরকার, তা করা যাচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা বাড়াতে।
ডিএমপির জনসংযোগ শাখার উপ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বেইলি রোডের ঘটনা অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা। এ ঘটনার পর রাজধানীতে বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ, রাজউক ও সিটি করপোরেশন। প্রকৃতপক্ষে এসব কাজ রাজউক ও সিটি করপোরেশনের। তারাই এসব ব্যবসার অনুমতি দিয়ে থাকে। গ্যাসের বিষয়টিও তারাই দেখে। ভবনের নকশার অনুমোদন দিয়ে থাকে রাজউক। এখানে পুলিশের কাজটি খুব কম।
এরপরও কোথাও অসঙ্গতি দেখলে সেটা বন্ধ করতে পারে পুলিশ। যেহেতু অন্যান্য সংস্থা বিভিন্ন কারণে সঠিকভাবে তদারকি করতে পারে না। পুলিশের যে ক্ষমতা আছে, সেই ক্ষমতার অংশ হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হয়। অগ্নিনীতিমালা না মেনে যারা অবৈধভাবে ব্যবসা করছে, তাদের অনেককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
তিনি আরও বলেন, আন্তমন্ত্রণালয়, ব্যবসায়ী সংগঠন, দোকান মালিক সমিতিসহ কীভাবে দুর্ঘটনা রোধ করা যায়, তা নিয়ে সমন্বয় সভা করে কাজ করছি। বর্তমানে ঢালাও অভিযান বন্ধ আছে। তার মানে এই না অভিযান বন্ধ হয়ে গেছে। এখন থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হবে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশন, রাজউক, তিতাস ও ফায়ার সার্ভিস যদি অভিযান চালায়, পুলিশ সহায়তা করবে। এ ছাড়া প্রয়োজন হলে পুলিশও অভিযান চালাবে।
ফায়ার ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শুধু অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়লে হবে না। অনিয়ম তো দীর্ঘদিন ধরে চলছে। তাই সবকিছু নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। সেবা সংস্থাগুলোকে মনিটরিং করতে হবে। তবেই শৃঙ্খলায় ফিরবে।