পবিত্র মাহে রমজানের ১১ তারিখ গত হচ্ছে আজ শুক্রবার। রমজানের অন্যতম সওগাত ইতিক্বাফ এখন সমাগত। পরম করুনাময়ের নৈকট্য লাভের জন্য আগামী ২০ রমজান সূর্যাস্তের আগেই ইতিক্বাফের নিয়তে পরবর্তী দশদিনের জন্য মসজিদে অবস্হান নেবেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লীরা। সংযম ও আত্নশুদ্ধির প্রতীক রমজান মাসের অন্যতম নিয়ামত হল এই ইতিক্বাফ। অারবী শব্দ ইতিক্বাফের আভিধানিক অর্থ হলো বাধ্যতামূলকভাবে কোনো কিছুকে ধরে রাখা। আর আহকামে শরীয়াহর পারিভাষায়, আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করার অপর নাম ইতিক্বাফ। ইতিক্বাফের মূলভাবধারা হলো নির্দিষ্ট লক্ষ্যবিন্দুতে মন-মগজকে এমন দৃঢ়ভাবে নিবদ্ধ রেখে অবস্থান করা যে, সেদিক থেকে দৃষ্টি মোটেও অন্যকোনো দিকে ফিরবে না। অর্থাৎ মসজিদে অবস্থান করাই হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে। অন্য কোনো দিকে দৃষ্টি দিতে গেলে লক্ষ্যে পৌঁছা বিঘ্নিত হবেই। ইতিক্বাফ মূলত লাইলাতুল কদরের ফায়দা অর্জন ও নাজাত লাভের এক ঐশী আয়োজন। অন্য কথায় বলতে গেলে ইতিক্বাফ অনেকটা দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য অবস্থান ধর্মঘটের মতো। যতক্ষণ দাবি-দাওয়া আদায় না হবে ততক্ষণ অবস্থান থেকে একটুও নড়া হবে না। অনুরূপভাবে আল্লাহ তায়ালা যতক্ষণ পর্যন্ত লাইলাতুল কদরের বরকত ও ফজিলত লাভের সুযোগ না দিবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমি রমজান মাসে এই মসজিদ ছাড়া কোথাও নড়ব না, এই হল ইতিক্বাফ। ইতিক্বাফকে বলা যায় বান্দাহকে রিলিফ দেয়ার জন্য আল্লাহতায়ালার ধার্যকৃত একটি সময়কাল। আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহ ও সান্নিধ্য লাভ, গুনাহ-খাতা মাফ এবং বড় মাফের মর্যাদা অর্জনের জন্য একটি বিশেষ ওয়ার্কশপ। ইতিক্বাফের আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। তা হল, ১. ইতিক্বাফ রোজার ত্রুটিসমূহের ক্ষতিপূরণ করে। ২. আল্লাহপাক ইতিক্বাফকারীদের গুনাহর দরজা বন্ধ করে দেন। ৩. কুচিন্তা, কুকথা ও কুকাজ থেকে বিরত থাকার এক মহা প্রশিক্ষণ ইতিক্বাফ। ৪. সকল বিষয়ে সংযম শিক্ষা দেয়। ৫. ইতিক্বাফে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রয়োজনে ঘরবাড়ি, স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য সকল কিছু ত্যাগের জজবা পয়দা হয়। ৬. ইতিক্বাফ হলো রোজাদার বান্দার কাছ থেকে লাইলাতুল কদরের মতো মূল্যবান রাতটি যাতে হাতছাড়া হয়ে না যায়, মনিবের তরফ থেকে তারই হিকমতপূর্ণ ব্যবস্থা। ৭. হাদীসে বলা হয়েছে, ইতিক্বাফকারী যাবতীয় গুনাহ থেকে বেঁচে যায়। তার জন্য নেকীহসমূহ লিখা হয় ঐ ব্যক্তির মতো যে যাবতীয় নেক কাজ করে। ( ইবনে মাজাহ) ইতিক্বাফ সুন্নতে মুয়াক্কাদা কিফায়া। ইতিক্বাফ বিনা ওজরে ত্যাগ করা ঠিক নয়। তবে মসজিদ এলাকায় কোনো একজন যদি ইতিক্বাফ করে তাহলে এলাকার সবাই দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। আর কেউ না করলে সকলের ঘাড়েই দায়িত্ব চেপে থাকবে। আমরা ছোটখাট অজুহাত যোগাড় করে এমন একটি ফজিলতপূর্ণ কাজে অবহেলা করি। ফলে বিরাট মর্তবা থেকে বঞ্চিত হই। বিশ্ব ইতিহাস সাক্ষী এ পৃথিবীতে রাসূলে করীমের (সা.) মতো এতবড় ও এত কঠিন কোনো কাজের আঞ্জাম কেউ দিতে পারেনি। মহানবী (সাঃ) হাজারো বাধা বিপত্তি, ঘাত-প্রতিঘাত পায়ে দলে নিজ পরিবার থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী, সমাজ ও রাষ্ট্র সকলের হক আদায় করেছেন অতি সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে। আবার আল্লাহতায়ালার ইবাদত-বন্দেগীতেও তিনি ছিলেন সকলের অগ্রগামী। এতদসত্ত্বেও তিনি ইতিক্বাফ জীবনে খুব কমই ছেড়েছেন। তিনি যদি জীবনে ইতিক্বাফ দু’একবার ত্যাগ না করতেন তাহলে তাঁর উম্মতের ওপর ইতিক্বাফ করা ফরজ হয়ে যেতো। অনেকের পক্ষেই তা আদায় করা কঠিন হয়ে পড়তো। তাই যাদের তেমন কোনো ওজর নেই তাদের উচিত এই মর্তবাপূর্ণ ইবাদতে শামিল হয়ে লাইলাতুল কদরের রহমত, বরকত ও ফজিলত হাসিল করে আল্লাহতায়ালার প্রিয়ভাজন হবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। ইতিক্বাফকারীদের জন্য কয়েকটি কাজ নিষেধ আছে। ১. প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না। ২. স্ত্রী সহবাস করার সুযোগ নেই। ৩. রোগী দেখার জন্য যাওয়া যাবে না। ৪. দূরে কারো জানাজায় যাওয়া যাবে না। ৫. রোজা ভঙ্গ করা যাবে না। তাহলে ইতিক্বাফ হবে না। ৬. পুরুষেরা জামে মসজিদ ছাড়া ইতিক্বাফ করতে পারবে না। বরকত ও ফজিলতপূর্ণ এ ইবাদাত শুরু হতে আরো ১০ দিন সময় আছে। এর মধ্যে আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইতিক্বাফের প্রস্তুতি নেয়ার তৌফিক দিন, আমিন।
লেখক:
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
কক্সবাজার।