তথাকথিত রাজনৈতিক ও নানা অপকর্মের সাথে জড়িতরা নিজেদের অপরাধ ঢাকতে পত্রিকার সম্পাদক, ভাড়াটে সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদ ব্যবহার করে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে চান। এটি শুধু জেলা শহরে নয়, জাতীয় পর্যায়েও এসবের চর্চা রয়েছে।
মূল বিষয় হলো আমরা কাউকে হজম করতে পারি না। আমি আমার কথা বলছি, সবজান্তা আমি নই। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই সবজান্তা মনে করি। এর মূল কারণ হিসেবে যদি আমি বলি, আমাদের মধ্যে অনেকের শিক্ষার স্বীমাবদ্ধতা রয়েছে। পড়তে নারাজ আমরা। পড়ার মধ্যে থাকলে যে, অনেক জ্ঞানের সমন্বয় হয় এটি বুঝি না মোটেও। আমাদের মনে রাখতে হবে, ভালো পরামর্শ দিতে গেলে নিজের মধ্যেও ভালো গুণ থাকা দরকার। এটা দোষের কিছু নয়। চিন্তার জায়গা থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে। মানসিক রুচিবোধও যে আছে, তা আমার বুঝি না।
একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি, ২০০৪ সাল থেকে শিক্ষানবিশ স্টাফ রিপোর্টার থেকে ক্রমে সংবাদপত্রের সবচে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা সম্পাদক পদটিও ছোঁয়েছি অনেক বছর পূর্বে। অথচ শনি-শনি আটদিন হয়নি, এসময়ে তিনিও কোন না কোন মাধ্যমের বার্তা সম্পাদক পরিচয় দিচ্ছেন। আপনাদের হাসি না পেলেও আমার হাসি পায়। কেন জানেন?
সাব- এডিটর অথবা বার্তা সম্পাদক পরিচয় বহন করা একজন সাংবাদিককে সংবাদ সংক্রান্ত সকল সংস্করণের পরিকল্পনা প্রণয়নের দায়িত্ব নিতে হয়। উপজেলা, জেলা ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বার্তা কক্ষে পাঠানো সংবাদকে সুন্দর, যথাযথ ও নির্ভুলভাবে তুলে ধরার যথেষ্ট দক্ষতা থাকতে হবে।
সাব-এডিটর গণমাধ্যমের নেপথ্য নায়ক ও সংবাদপত্রের মেরুদণ্ড বলা হয়ে থাকে। তার সম্পাদনার দক্ষতার বৈচিত্র্যতা দিয়ে হাউজের ভাবমর্যদা নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। এটি আমার কথা নয়, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার সর্বোচ্চ পর্যায়ের একাডেমিক বইতে এমনটি বলা আছে। এ বিষয়ে মাস্টার্স অব ফিলোসফি (এমফিল) স্নাতকোত্তর পর্যায়ে একটি গবেষণামূলক ডিগ্রি। প্রোগ্রামটি করতে গিয়ে শিখছি প্রতিনিয়ত।
২০১৫ সালে কক্সবাজারের প্রায় ১০০ বছরের সাংবাদিকতার ইতিহাস নিয়ে আমার প্রণিত ‘কক্সবাজার সাংবাদিক কোষ’ ও ২০২৪ সালে ‘মফস্বল সাংবাদিকতার যতকথা’ প্রকাশ পেয়েছে। বই দু’টো সাংবাদিকতা বিষয়ক। আমি জানিনা কয়জনে বই দু’টো সংগ্রহ করেছেন। পড়ার মানসিকতা না থাকুক। লেখায় আপনার মত জীবন ঘনিষ্ট হতে পারিনি ঠিক আছে; ঘরের ছেলে, জাত ভাই কষ্ট করে সাংবাদিকতা সংশ্লিষ্ট বই প্রকাশ করেছে। কৌতুহল বসে হলেও একটা বই সংগ্রহ করা উচিত। টাকা খরচ করে বই বের করেছি। একটি বই কিনলে কিছু রয়েলিটির মালিক হই আপনি নিশ্চয়ই চান?
দেশের বিভিন্ন জেলায় ‘মফস্বল সাংবাদিকতার যতকথা’ বইটি যখন পার্সেল করা হয় তখন অনেক ভাল লাগে। আমার আরো গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট থিসিসসহ তিন সাংবাদিকতা বিষয়ক বই প্রকাশ পাচ্ছে। সেখানেও যা প্রকাশ হয়েছে সবটাতে চেষ্টা করেছি বাংলাদেশের সংবাদপত্র, সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের নিয়ে বিষদভাবে বিশ্লেষণ করতে।
যাই হোক, তথাকথিত রাজনৈতিক ও নানা অপকর্মের সাথে জড়িতরা নিজেদের অপরাধ ঢাকতে পত্রিকার সম্পাদক, ভাড়াটে সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদ ব্যবহার করে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে চান। এটি শুধু জেলা শহরে নয়, জাতীয় পর্যায়েও এসবের চর্চা রয়েছে। এই বিষয়টি অবতারণা করতে এভাবে উপরোক্ত বিষয়টি উপস্থাপন করেছি।
আসল কথা বলছি এবার, পয়সা খরচ করে যেনতেন একটা আইডি কার্ড কিনে সাংবাদিক বনে যাচ্ছেন অনেকে তাই না? অপেশাদার কথিত সাংবাদিকরা অনেক ক্ষেত্রে অপকর্ম করতে রাজনৈতিক ও গণমাধ্যমের ছত্রছায়ায় থাকে। এদের কারণে পেশাদার সাংবাদিকদের মর্যাদা ধুলায় ভুলন্ঠিত হচ্ছে। আসলে কথিত রাজনৈতিক ও নানা অপকর্মের সাথে জড়িত যেসব মানুষ এ মাধ্যমে কাজ করার জন্য আসছেন সবাই তু এমন হওয়ার কথা নয়!
আমরা যারা সিনিয়র বলে এ পেশায় দর্পে দাবিয়ে বেড়াচ্ছি তাদের ছত্রছায়ায় এসব অপরাধিরা। আর আন্ডারগ্রাইন্ড পত্রিকায় হুট করে করে সংবাদপত্রের সাব-এডিটর অথবা বার্তা সম্পাদকের মত গুরুত্বপূর্ণ পদটিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অদক্ষ লোকটাকে নামে মাত্র অথবা বিনা সম্মানীতে দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি। যা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
মার্কিন সাংবাদিক আর ডি ব্লুমেনফ্রেল্ডের মতে, যিনি সংবাদ সংগ্রহ করে তা প্রকাশ উপযোগী করেন এবং সংবাদ-সংক্রান্ত কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনিই সাংবাদিক।
এ যদি হয়; তাহলে এসব করতে আসল মানুষগুলো আসুক। তাদের স্বাগতম জানানো হবে। আর এ রকম প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এগুতে পারলে দেশের সামগ্রিক সাংবাদিকতায় দেখা যাবে বিপুল বৈচিত্রময়তা। আর কোন প্রশ্ন ওঠার কথা নয়।
রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সরকার এবং সকল দলের পথ নির্দেশনা তৈরি যদি সংবাদপত্র করে দেয়, তাহলে সেসব সংবাদপত্র কারা পরিচালনা করবেন এসবের ও নীতিগত মূল্যায়ন আছে। কালো টাকা সাদা করতে ব্যবসায়ী মাফিয়া ডন ও নানা অপকর্মের সাথে জড়িতরা সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং টেলিভিশন খুলে বসে থাকে। এসব করতে আমাদের সিনিয়র যারা নেতৃত্বশ্রেণির তারাই সুযোগ করে দিচ্ছেন। এখান থেকে যতদিন বের হতে পারবো না ততদিন সুষ্ঠু সাংবাদিকতা চর্চা হবে না।
অপসাংবাদিকদের ভিড়ে প্রকৃত সাংবাদিকদের মর্যাদা আজ ধুলায় ভুলন্ঠিত। কেন এমন হচ্ছে? একজন সাংবাদিক দেশে ও সমাজের কল্যাণে নিবেদিত হবেন; সাংবাদিকতায় এটি স্বতঃসিদ্ধ। মহান পেশার আদর্শ উদ্দেশ্য উল্টে ফেলা হচ্ছে; সৎ সাংবাদিকদের বিতর্কিত করা হচ্ছে; নানা স্বার্থে সংবাদপত্রকে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। কারা করছে এসব? আমরা সবাই জানি।
আজ কেন সাংবাদিকতা বাণিজ্যের ভিড়ে সংবাদপত্র এবং প্রকৃত সাংবাদিকরা অপসৃয়মাণ? কেন মর্যাদাসম্পন্ন পেশা, মর্যাদা হারাচ্ছে। কেন শুদ্ধতার মাঝে ঢুকে পরেছে নাম সর্বস্ব অপসাংবাদিকতা। পেশা নয় যেন অসুস্থ ব্যবসা। বড্ড ঘৃণা হয় আমার।
গোড়ায় হাত দিতে হবে আমাদের। সংবাদপত্র ও টেলিভিশন অনুমোদন নেওয়ার আগেই দেখতে হবে পত্রিকা ও টেলিভিশন চালানোর সক্ষমতা রয়েছে কিনা। দেখতে হবে হাউজের সার্বিক বিষয় ও সকল জনবলকে ওয়েজবোর্ড এর আওতায় বেতনকাঠামো ঠিক রেখে গণমাধ্যম পরিচালনা করতে পারবে কিনা। এটি ঠিক করতে পারলেই মাঠ পর্যায়ে ও হাউজকেন্দ্রিক যত সমস্যা ঠিক হবে। আর ভুঁইফোড় মাধ্যম ও সাংবাদিক তৈরি হবে না।
অশিক্ষিত, কুশিক্ষিতরা অর্থের বিনিময়ে আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে মানুষকে ভয়ভীতি; আর সরলতার সুযোগ নিয়ে হরদম প্রতারণা করবে না।
দেশের গরিষ্ঠ মানুষ, না বলুক। সাংবাদিক মানেই ধান্ধাবাজ ও প্রতারক।
দেশের কিছু অসৎ সম্পাদক, সাংবাদিক অর্থের বিনিময়ে সারা দেশে নানা অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের সংবাদপত্রের অনুমোদন দিতে সহায়তা করে এবং সাংবাদিকতার পরিচয়পত্র দিয়ে এ পেশার সম্মানহানি করে। এ চর্চা থেকে বেরিয়ে আসুক দেশ।
বলতে দ্বিধা নেই, যে কারো হাতে যেভাবে ছুরি কাঁচি তুলে দিয়ে অপারেশনের সার্জন বানিয়ে দেয়া গ্রহণযোগ্য হয় না, একইভাবে যে কারো হাতে পরিচয়পত্র, কলম-ক্যামেরা-বুম তুলে দিয়ে তাকে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারের দায়িত্ব দেয়াটাও গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত নয়।
এদের রাহুগ্রাস থেকে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের বেরিয়ে আসতে হবে। এমনিতেই নিরাপত্তার অভাবে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে মুক্ত সাংবাদিকতার দ্বার। এভাবে চলতে থাকলে একদিন মেধাবী, যোগ্য, তথ্যপ্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা এখন যে সংবাদপত্রে ঢুকছেন, তারা নিরুৎসাহিত হবেন নিশ্চিত।
ভুঁইফোড় ভাড়াটে সম্পাদক, সাংবাদিককে না বলি। আসুন তবে, সংকল্পবদ্ধ একদল কর্মীবাহিনীর মাধ্যমে পরিচালিত হোক একটি হাউজ। তবেই স্বার্থক একজন কর্মঠ, মেধাবি সম্পাদক। এগিয়ে গেলেই সুখ...
লেখক: গণমাধ্যম-সাংবাদিকতায় এমফিল গবেষক ও সাংবাদিক
একাধিক বইয়ের প্রণেতা (গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট)
সভাপতি- কক্সবাজার সাংবাদিক সংসদ (সিএসএস)
০১৮৪৫ ৬৯ ৫৯ ১৬ (azadcox90@gmail.com)