বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের এক দফা দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশে ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। এতে সোমবার (৫ আগস্ট) আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে সারাদেশের জনগণ। তবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষুব্ধ জনতা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও হামলায় অন্তত ১৪৮ জন নিহত হয়েছেন। বিস্তারিত জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্টে.....বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘিরে সোমবার (৫ আগস্ট) রাজধানীতে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে বহু হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। নিহতদের মধ্যে ৪০ জনের মরদেহ রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক)। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের পরিচয় শনাক্ত হয়নি। একইসঙ্গে ঢামেকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে ৩৯৭ জনকে এবং ভর্তি নেওয়া হয়েছে ৭১ জনকে।
মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) সকালে ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সাভারে নিহত ২৫
সাভারে ২৫ জন নিহত হয়েছেন। এ সময় প্রায় দুই শতাধিক মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে সংবাদ পাওয়া গেছে। অধিকাংশ মৃত্যুই গুলিতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের কর্মকর্তারা। রোববার (০৫ আগস্ট) দিনভর সংঘর্ষে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে।
সাভারের বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৮, নারী ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ৩, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ৬, হ্যাপী জেনারেল হাসপাতালে ১ ও হাবিব ক্লিনিকে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ওইসব হাসপাতালগুলোতে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ।
সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানাজার ইউসুফ আলী বলেন, আহতদের অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। নিহতদের মধ্যে দুইজন অজ্ঞাত রয়েছেন। তাদের পরিচয় জানার চেষ্টা চালছে।
নারী ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্রের অপারেশন ম্যানাজার হারুন-অর-রশিদ জানান, তিন মরদেহের মধ্যে একজনের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে না। থানা পুড়িয়ে দেওয়ায় মরদেহটি নিয়ে বিপাকে রয়েছি। এছাড়াও হাবিব ক্লিনিকেও অজ্ঞাত দুইজনের মরদেহ পড়ে রয়েছে।
যশোরে হোটেলে আগুন, নিহত ২৪
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের মালিকানাধীন পাঁচ তারকা হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশনালে অগ্নিসংযোগে ২৪ জন নিহত হয়েছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পদত্যাগের পর সোমবার (৫আগস্ট) বিকেল চারটার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
যশোর ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক এএম মামুন মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) জানান, জাবির হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকে।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, জাবির হোটেলে অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত ২৪ জনের মরদেহ হাসপাতালের মর্গে আনে ফায়ার সার্ভিসের টিম। আহত হয়েছেন দেড়শ জনের মতো। আহতদের মধ্যে অনেকেই আশঙ্কাজনক।
কুষ্টিয়ায় নিহত ৮
কুষ্টিয়ায় সংঘর্ষে শিশুসহ অন্তত ৮ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। সোমবার (৫ আগস্ট) দুপুরে কুষ্টিয়া মডেল থানা ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে হামলাকে কেন্দ্র করে পুলিশ গুলি চালালে হতাহতের এ ঘটনা ঘটে।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক রফিকুল ইসলাম জানান, গুলিবিদ্ধ নিহত চারজনকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও চারজনের মৃত্যু হয়।
হবিগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত ৬
হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে শিশুসহ ছয়জন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় পুলিশসহ আহত হয়েছেন আরও শতাধিক।
বানিয়াচং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শামীমা আক্তার বলেন, ৬ জনের মরদেহ আমরা পেয়েছি। নিহতদের মধ্যে শিশুও রয়েছে।
গাজীপুরে সংঘর্ষে নিহত ৯
গাজীপুরের শ্রীপুরে বিজিবির সঙ্গে সংঘর্ষে ৬ জন, মহানগরীর বাসন থানায় পুলিশের গুলিতে একজন ও কালিয়াকৈরে আনসার সদস্যদের গুলিতে দুইজন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এতে অর্ধশতাধিক আন্দোলনকারী ও উৎসুক জনতা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এ সময় শ্রীপুরে বিজিবির তিনটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. জারিন ফারা বলেন, বিকেলের দিকে চারজন ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিয়েছেন।
মানিকগঞ্জে গুলিতে কলেজছাত্র নিহত
মানিকগঞ্জে নৌপুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া পাল্টাধাওয়ায় গুলিবিদ্ধ হয়ে রফিকুল ইসলাম চঞ্চল (২১) নামে এক কলেজছাত্র নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আন্দোলনকারীরা উত্তেজিত হয়ে নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি ও শিবালয় থানায় আগুন ধরিয়ে দেয়।
সোমবার (৫ আগস্ট) নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক অমিত রায়। নিহত রফিকুল ইসলাম চঞ্চল উপজেলার রুপসা গ্রামের রহিজ উদ্দিনের ছেলে ও মানিকগঞ্জের মহাদেবপুর ইউনিয়ন ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী।
চুয়াডাঙ্গায় যুবলীগ নেতার বাড়িতে আগুন, নিহত ৪
চুয়াডাঙ্গা শহরের সিনেমা হল পাড়ায় জেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক আরেফিন আলমের বাড়িতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে পুড়ে ছাই হয়ে গেছেন চারজন।
চুয়াডাঙ্গা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, দীর্ঘ প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর ভবনের চারতলায় চারজনের মরদেহ পাওয়া গেছে। মরদেহ পুড়ে বিকৃত হওয়ায় পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।
ঝিনাইদহে চেয়ারম্যানসহ নিহত ৪
ঝিনাইদহ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ৯ নম্বর পোড়াহাটি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম হিরনকে (৫৫) পিটিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। একই সময় তার গাড়িচালক আক্তার মিয়াকে (৪০) কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
এদিকে কালীগঞ্জ শহরের ঢাকালে পাড়ায় আগুনে পুড়ে রাব্বি (১৩) এবং মনজু (২০) নামের দুজনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার বিকেলের বিভিন্ন সময় এ ঘটনা ঘটে।
চাঁদপুরে চেয়ারম্যান ও তার ছেলেকে পিটিয়ে হত্যা
চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের আলোচিত চেয়ারম্যান সেলিম খান ও তার ছেলে নায়ক শান্ত খানকে পিটিয়ে হত্যা করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা। সোমবার (৫ আগস্ট) শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পর নিজ এলাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় বালিয়া ইউনিয়নের ফরক্কাবাদ বাজারে এসে জনরোষে পড়েন তিনি। সেখানে নিজের পিস্তল থেকে গুলি করে পালিয়ে বাগাড়া বাজারে এলে ফের জনতার মুখোমুখি হন। সেখানেই তাকে এবং তার ছেলেকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
চাঁদপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শেখ মুহসীন আলম বলেন, তাদের মৃত্যুর বিষয় আমরা জেনেছি। তবে আমাদের জানমালের নিরাপত্তার কারণে সেখানে যাইনি।
কয়রায় উপজেলা চেয়ারম্যানকে পিটিয়ে হত্যা
খুলনার কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিএম মোহসিন রেজাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর তার মরদেহ যেন খুঁজে না পাওয়া যায় সেজন্য আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। কয়রার আরও দুই জন সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধি সেখানে ছিলেন বলে এলাকাবাসী জানায়।
কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান বলেন, বিষয়টি শুনেছি। তবে উপর মহলের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত আমরা কিছু করতে পারছি না। আমরা থানায় অবস্থান করছি।
লালমনিরহাটে আ’লীগ নেতার বাড়িতে ৬ মরদেহ
লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সুমন খানের থানা রোড (কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সংলগ্ন) এলাকার বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছেন বিক্ষুব্ধরা। এ ঘটনার পর তার বাড়ি থেকে ৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
সোমবার (৫ আগস্ট) রাত তিনটায় মরদেহগুলো আওয়ামী লীগ নেতার পুড়ে যাওয়া ভবন থেকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। নিহতদের মরদেহ এখনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ৬ জনের মরদেহ লালমাইয়ের সদর হাসপাতালে রাখা হয়েছে। এদিন বিকেলে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় বাড়িতে আওয়ামী লীগ ও তার পরিবারের কেউ ছিল না।
শরীয়তপুরে নিহত ১
শরীয়তপুরের জাজিরায় মাসুদ বেপারী (৩৫) নামের এক যুবক গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। সোমবার (৫ আগস্ট) বিকেলে উপজেলার হরিয়াসা এলাকায় আন্দোলনকারী ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের সময় মাসুদ গুলিবিদ্ধ হন। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন।
জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, বিকেলে এক যুবককে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা গেছেন।
নাটোরে এমপির পুড়ে যাওয়া বাড়িতে ৪ মরদেহ
নাটোরে সংসদ সদস্য মো. শফিকুল ইসলাম শিমুলের বাসভবন জান্নাতি প্যালেস থেকে অগ্নিদগ্ধ চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) সকালে শহরের কান্দিভিটুয়া এলাকায় সংসদ সদস্য শিমুলের বাড়িতে সাধারণ মানুষ মরদেহ দেখতে পায়।
দিনাজপুরে মেয়রের বাড়িতে ২ মরদেহ
দিনাজপুরের হাকিমপুর পৌর মেয়র জামিল হোসেন চলন্তর বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার পর তার বাড়ি থেকে দুইজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সোমবার (৫ আগস্ট) রাত সাড়ে ১১টায় পুড়ে যাওয়া বাড়ি থেকে মরদেহগুলো উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। এর আগে বিকেলে আগুনের ঘটনা ঘটে। এ সময় বাড়িতে মেয়র ও তার পরিবারের কেউ ছিলেন না।
উত্তরায় গুলিতে নিহত ৯
গণ আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়লে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। থানায় থানায় হামলা হয়। এসব ঘটনায় পুলিশের গুলিতে উত্তরায় ৯ জন মারা গেছেন। আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৩৫ জনের বেশি মানুষ।
মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালের পরিচালক (প্রশাসন) নাজমুল হাসান জাগো নিউজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
কুমিল্লায় দুই পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা
কুমিল্লার তিতাসে গণপিটুনীতে দুই পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। সোমবার (৫ আগস্ট) রাত ১টার দিকে জেলার তিতাস থানায় এ ঘটনা ঘটে।
তিতাস থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাঞ্চন কান্তি দাস বলেন, সোমবার দুপুর ১২টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা দফায় দফায় থানায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেন। এক পর্যায়ে রাত ১টার দিকে থানার গেইটে দায়িত্বে থাকা আমার দুই সহকর্মীকে তারা পিটুনী দিয়ে হত্যা করেন। এছাড়াও তাদের হামলায় আমিসহ আমার অনেক সহকর্মী আহত আছেন। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী আমাদের উদ্ধার করেন।