সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুর কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’কে। বুধবার (১২ মার্চ) বেলা ১১টা পর্যন্ত এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি উপকূল থেকে প্রায় ২৭৫ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছে। অগ্রসর হচ্ছে সোমালিয়ার দিকে। এমনটাই জানিয়েছেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সাধারণ সম্পাদক মো. শাখাওয়াত হোসেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা জলদস্যুর কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজের অবস্থান শনাক্ত করতে পেরেছি। জাহাজটিকে সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’ জাহাজটির চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বিকালে এক অডিও বার্তা পাঠান জাহাজটির দেশে থাকা মালিকদের কাছে। আতিক উল্লাহ খানের পাঠানো ওই তিন মিনিট ৩৪ সেকেন্ডের অডিও বার্তায় উঠে এসেছে জাহাজটি জলদস্যুরা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল ও এর আদ্যোপান্ত।
সেই অডিও বার্তায় আতিক উল্লাহ খান বলেন, ‘আসসালামুলাইকুম স্যার, আমি চিফ অফিসার বলছিলাম, আবদুল্লাহ জাহাজ থেকে। আজকে সকালে জাহাজে সময় তখন সকাল সাড়ে ১০টা। গ্রিনিচ মান সময় ৭টা ৩০ মিনিট (বাংলাদেশ সময় বেলা দেড়টা)। ওই সময় একটা হাই স্পিডবোট আমাদের দিকে আসতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে আল্যার্ম দিই। আমরা সবাই ব্রিজে গেলাম। ক্যাপ্টেন স্যার আর জাহাজের দ্বিতীয় কর্মকর্তা ব্রিজে ছিলেন তখন। আমরা এসওএস (জীবন বাঁচানোর জরুরি বার্তা) করলাম। ইউকে এমটিওতে (যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন) যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। তারা ফোন রিসিভ করেনি। এরপর ওরা চলে এলো। তারা ক্যাপ্টেন স্যার ও দ্বিতীয় কর্মকর্তাকে ঘিরে ফেললো। আমাদের ডাকলো। আমরা সবাই এলাম। এ সময় কিছু গোলাগুলি করলো। সবাই ভয় পেয়েছিলাম। সবাই ব্রিজে বসে ছিল। তবে কারও গায়ে হাত দেয়নি।’
আরও বলেন, ‘এ সময় একটা স্পিডবোটে আরও কয়েকজন চলে এলো। এভাবে ১৫-২০ জন এলো জাহাজটিতে। এর কিছুক্ষণ পর একটি বড় ইরানিয়ান ফিশিং বোট নিয়ে আরও জলদস্যু চলে আসে। ইরানিয়ান ওই ফিশিং বোটটি এক মাস আগে তারা জিম্মি করেছিল। এটি দিয়ে তারা এক মাস ধরে নতুন কোনও জাহাজ জিম্মি করার জন্য সাগরে ঘোরাঘুরি করছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা সামনে পড়ে গেলাম। এখন ওই মাছ ধরার জাহাজ ছেড়ে দেবে। তবে সেটির জ্বালানি ফুরিয়ে গেছে। এখন আমাদের থেকে ডিজেল নিচ্ছে। আমাদের জাহাজটি থামিয়েছে তারা। জাহাজের কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আমাদেরও কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে ভয়ে আছি।’
‘আমাদের জাহাজে ২০-২৫ দিনের খাবার পানি আছে। প্রায় ২০০ টনের মতো। সবাইকে বলেছি, এগুলো একটু সাবধানে ব্যবহার করতে। শেষ হয়ে গেলে বিপদে পড়বো আমরা। তবে একটা সমস্যা হচ্ছে, আমাদের জাহাজে কিছু কোল্ড কার্গো আছে। প্রায় ৫৫ হাজার টন। এগুলো একটু ডেঞ্জারাসও। ফায়ারেরও ঝুঁকি আছে। লাস্ট যখন অক্সিজেন মেপেছি তখন ৯-১০ শতাংশ লেভেল পেয়েছি। এটি নিয়মিত মনিটরিং করতে হয়। কোনও কারণে অক্সিজেন লেভেল বেড়ে গেলে বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে হবে। এটার একটু ব্যবস্থা করবেন, স্যার।’
‘আমাদের জন্য দোয়া করবেন, স্যার। আমাদের পরিবারকে একটু দেখবেন, স্যার। সান্ত্বনা জানাবেন, স্যার। আসসালামুলাইকুম।’ এ অডিও বার্তার বিষয়টি বাংলা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করেন মেরিন অফিসার্সদের সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সাধারণ সম্পাদক মো. শাখাওয়াত হোসেন।
তিনি বলেন, ‘জিম্মি হওয়া জাহাজের চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান মঙ্গলবার এ অডিও বার্তা পাঠান জাহাজটির মালিক পক্ষের কাছে। জিম্মি হওয়া জাহাজটিতে ২৩ জন নাবিক-ক্রু আছেন। এখন পর্যন্ত তারা ভালো আছেন নিরাপদে আছেন।’
জাহাজে থাকা ২৩ জনের পরিচয় :
জাহাজের মাস্টার হিসেবে আছেন চট্টগ্রামের রাশেদ মোহাম্মদ আব্দুর, চিফ অফিসার হিসেবে আছেন চট্টগ্রামের খান মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ, সেকেন্ড অফিসার হিসেবে আছেন চট্টগ্রামের চৌধুরী মাজহারুল ইসলাম, থার্ড অফিসার হিসেবে আছেন ফরিদপুরের ইসলাম মো. তারেকুল, ডেক ক্যাডেট হিসেবে আছেন টাঙ্গাইলের হোসাইন মো. সাব্বির।
এ ছাড়া চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আছেন নওগাঁর শাহিদুজ্জামান এ এস এম, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আছেন খুলনার ইসলাম মো. তৌফিকুল, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আছেন নেত্রকোনার উদ্দিন মো. রোকন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আছেন চট্টগ্রামের আহমেদ তানভীর, ইঞ্জিন ক্যাডেট হিসেবে আছেন লক্ষ্মীপুরের খান আইয়ুব, ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে আছেন উল্লাহ ইব্রাহিম খলিল, এবিল সি-ম্যান (নাবিক) হিসেবে আছেন নোয়াখালীর হক মোহাম্মদ আনোয়ারুল, চট্টগ্রামের রহমান মো. আসিফুর, চট্টগ্রামের হোসাইন মো. সাজ্জাদ, অর্ডিনারি সি-ম্যান (সাধারণ নাবিক) হিসেবে আছেন নাটোরের মোহাম্মদ জয়, সিরাজগঞ্জের হক মো. নাজমুল, ওয়লার হিসেবে আছেন চট্টগ্রামের হক আইনুল, চট্টগ্রামের শামসুদ্দিন মোহাম্মদ, বরিশালের হোসাইন মো. আলী, ফায়ারম্যান হিসেবে আছেন চট্টগ্রামের শাকিল মোশাররফ হোসেন, চিফ কুক হিসেবে আছেন চট্টগ্রামের ইসলাম মো. শফিকুল, জেনারেল স্টুয়ার্ড হিসেবে আছেন চট্টগ্রামের মোহাম্মদ নূর উদ্দিন ও ফাইটার হিসেবে আছেন নোয়াখালীর আহমেদ মোহাম্মদ সালেহ।
মঙ্গলবার (১২ মার্চ) দুপুর দেড়টার দিকে কবির গ্রুপের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়ার খবর জানতে পারেন গ্রুপের কর্মকর্তারা।
এসআর শিপিংয়ের মিডিয়া অ্যাডভাইজার মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘কবির গ্রুপের মালিকানাধীন জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়েছে। জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সোমালিয়া জলদস্যুরা। জাহাজে মোট ২৩ জন নাবিক ছিল। তারা সবাই নিরাপদে আছেন।’