চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কপথে হঠাৎ করে কমে গেছে মাদক পরিবহন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক টিম চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে চেকপোস্ট বসিয়ে অভিযান পরিচালনা করলেও মাদক বহনকারীরা আগের মতো ধরা পড়ছে না। কক্সবাজার-ঢাকা রুটে ট্রেন চলাচল শুরুর পর থেকে সড়কপথে মাদক পরিবহন কমেছে; এমনটাই দাবি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।
কক্সবাজার থেকে ট্রেনে ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক পরিবহন ঠেকাতে বিশেষ জোন করার পরিকল্পনার কথা ভাবছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। পাশাপাশি সংস্থাটি কক্সবাজার ট্রেন স্টেশনের প্রবেশপথে যাত্রী এবং মালামালের ভেতর মাদক শনাক্তে আধুনিক ড্রাগ ডিটেকটিং স্ক্যানার বসাতে চাইছে। এমনকি প্রশিক্ষিত ডগ স্কোয়াডের সাহায্যে মাদক উদ্ধারে অভিযান চালাতে চাইছে সংস্থাটি। এজন্য প্রয়োজনীয় জনবলসহ সরঞ্জাম চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে প্রধান কার্যালয়ে।
সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, আশঙ্কা করা হচ্ছে, সড়ক পথে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি এড়াতে মাদক পাচারকারী চক্রের একটি অংশ ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক পাচারে ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বেছে নিতে পারে।
এ প্রসঙ্গে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. জাফরুল্লাহ কাজল বলেন, ‘ট্রেনে মাদক পরিবহন করা হচ্ছে, এ ধরনের তথ্য আছে আমাদের কাছে। কক্সবাজার ট্রেনে যাত্রী উঠলে বাধাহীনভাবে চলে যাচ্ছে ঢাকায়। এতটুকু পথে সড়কপথে অনেক চেকপোস্ট আছে। অথচ ট্রেনে তা নেই। ট্রেনে যাতায়াতকারী সন্দেহজনক যাত্রীদের শরীর এবং ব্যাগ বাধাহীনভাবে আমরা তল্লাশি করতে চাই। এ কাজে সহযোগিতা জন্য রেলওয়েকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশে ইয়াবা ঢুকছে কক্সবাজার টেকনাফ হয়ে। কক্সবাজার-ঢাকা রেলপথে মাদকের পাচার ঠেকাতে কক্সবাজার রেলওয়েতে বিশেষ জোন করার প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে প্রধান কার্যালয়ে। বিশেষ জোনের জন্য একজন সহকারী পরিচালকসহ ৩২ জন জনবল, একটি ডাবল কেবিন পিকআপ, যাত্রীদের তল্লাশির জন্য পোর্টেবল ও আধুনিক ড্রাগ ডিটেকটিং স্ক্যানার ও এক্সরে মেশিন, প্রশিক্ষিত ডগ স্কোয়াড চাওয়া হয়েছে।’
সম্প্রতি ট্রেনে তল্লাশি ও অভিযান পরিচালনায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চেয়ে দেওয়া চিঠিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলেছে, ‘বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজার দীর্ঘদিন ধরে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে ইয়াবা, আইসসহ বিভিন্ন ভয়াবহ মাদক পাচারের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কক্সবাজার থেকে এ সকল মাদক নিত্যনতুন কৌশলে সড়ক, নৌ ও আকাশ পথে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে।’
এতে বলা হয়, সড়কপথে মাদক পাচার রোধে টেকনাফ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কে পুলিশ, বিজিবি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ৮ থেকে ১০টি চেক পোস্ট স্থাপন করেছে। এ সকল চেকপোস্টে নিয়মিত যাত্রীবাহী বাসসহ সকল যানবাহন তল্লাশি করা হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, চট্টগ্রাম মেট্রো কার্যালয়, জেলা কার্যালয় ও গোয়েন্দা কার্যালয় ২০২২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দুই বছরে ২ হাজার ৯৩৭টি মামলায় ৩ হাজার ১৮৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যার মধ্যে ৯৬৯টি মামলা চেকপোস্টে উদঘাটিত হয়েছে।
এসব মামলায় ১ হাজার ৩৩ জনকে ২০ লাখ ৬২ হাজার ৯৪২ পিস ইয়াবা, ১ কেজি হেরোইন, ২ গ্রাম আইস, ৪২০ লিটার চোলাই মদ, ১০টি সোনার বারসহ আটক করা হয়। এছাড়া মাদক পরিবহনে ব্যবহৃত একটি মাইক্রোবাস, একটি মিনি বাস ও একটি মিনি ট্রাক জব্দ করা হয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, গত বছরের ১ ডিসেম্বর থেকে কক্সবাজার থেকে ঢাকা পর্যন্ত চালু হলো আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস। বর্তমানে কক্সবাজার থেকে ঢাকা পর্যন্ত দুটি বিরতিহীন ট্রেন চলাচল করছে। আরও ট্রেন সার্ভিস বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সড়ক পথে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি এড়াতে মাদক পাচারকারী চক্রের একটি অংশ ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক পাচারে ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বেছে নিতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছর জানুয়ারিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, জেলা টাস্কফোর্স, কোস্টগার্ড পূর্বজোন, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ, র্যাব, কাস্টমস হাউস ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) চট্টগ্রামে অভিযান চালিয়ে ৩ লাখ ১ হাজার ১৭৩ পিস ইয়াবা, ১২৯ কেজি ৮২০ গ্রাম গাঁজা, ৩ হাজার ১২৯ লিটার চোলাই মদ, ৩১ লিটার বিদেশি মদ, ৩৯০ ক্যান ফেনসিডিল. ৬৯৫ বোতল বিয়ার, হুইস্কি ৪ বোতল, ভদকা ১৪ বোতল উদ্ধার করে।
একইভাবে ফেব্রুয়ারিতে ১ লাখ ৬৩ হাজার ২১৬ পিস ইয়াবা, ১৪৭ কেজি ৭৩ গ্রাম গাঁজা, ৪ হাজার ২৩৪.২৫ লিটার চোলাই মদ, ২০৭ লিটার বিদেশি মদ, ১৩৮ ক্যান ফেনসিডিল, হুইস্কি ৪ বোতল, ভদকা ৮ বোতল ও ক্রিস্টাল মেথ আইস ১ কেজি উদ্ধার করে।
মার্চ মাসেও ২ লাখ ৬৭ হাজার ৬৬৪ পিস ইয়াবা, ২২৭ কেজি ১১৯ গ্রাম গাঁজা, ২ হাজার ৩৪৪ লিটার চোলাই মদ, ১৩১ লিটার বিদেশি মদ, ৫৯৯ ক্যান ফেনসিডিল উদ্ধার করে এবং এপ্রিলে ১ লাখ ৮৩ হাজার ২৭২ পিস ইয়াবা, ৮১ কেজি ৫৯ গ্রাম গাঁজা, ৪ হাজার ৭২৭ দশমিক ৩৫ লিটার চোলাই মদ, ৭২ লিটার বিদেশি মদ, ৬২ ক্যান ফেনসিডিল, ৮৬৩ বোতল বিয়ার, হুইস্কি ১৩০ বোতল, ভদকা ২৪ বোতল ও আইস ১ কেজি উদ্ধার করা হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর চট্টগ্রাম মেট্রোর (উত্তর) উপ-পরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার বলেন, ‘সড়কপথে মাদক পরিবহন অনেক কমে গেছে। আগে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে অভিযান চালিয়ে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে পরিমাণ ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক উদ্ধার করতো তা এখন কমে গেছে। বলা যায়, ট্রেন চালুর পর থেকেই সড়কপথে মাদক পরিবহন অনেকটাই কমে গেছে।’
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আগে যারা সড়ক পথ ব্যবহার করতো তারা এখন রেলপথ ব্যবহার করছে; এমন তথ্য আছে আমাদের কাছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা বেশ উদ্বিগ্ন। কেননা কক্সবাজার থেকে আন্তঃনগর ট্রেনে মাদক নিয়ে বহনকারীরা উঠলে তারা কোন বাধা ছাড়াই ঢাকায় যেতে পারছেন। অপরদিকে সড়কপথে আছে বিভিন্ন সংস্থার নানা কড়াকড়ি। এ কারণে মাদক কারবারিদের কাছে পছন্দ রেলপথ।’
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার ওসি এস এম শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘কক্সবাজার রুটে ট্রেন চালু হওয়ার পর থেকে মাদক উদ্ধারের ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে একটি গত ১৮ মে কক্সবাজার স্টেশন থেকে ৪ হাজার পিস ইয়াবাসহ মো. ইউনুস (২৫) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।’
ওসি আরও বলেন, কক্সবাজার রুটে বর্তমানে তিনটি ট্রেন চলাচল করছে। এরমধ্যে দুটি আন্তঃনগর এবং একটি লোকাল ট্রেন। আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে ২১টি করে বগি আছে। এতে পুরো ট্রেনে মিলে পুলিশ সদস্য নিয়োজিত আছে মাত্র তিন জন করে। ক্ষুদ্র জনবল দিয়ে এতগুলো যাত্রীকে তল্লাশি করা মোটেও সম্ভব নয়। আমাদের জনবল সংকট আছে। কেননা থানার পরিধি বাড়লেও জনবল বাড়েনি। এ কারণে আমাদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।’