০৭:২৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা, সক্রিয় দালাল চক্র

নাফ নদীর এক পাড়ে কক্সবাজারের টেকনাফ অন্য পাড়ে রাখাইনের মংডু শহর। এই নদী বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত। নাফের ওপাড়ে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর চলমান যুদ্ধাবস্থার মধ্যেই তৎপর হয়ে উঠেছে দুই দেশের রোহিঙ্গা পারাপারের দালাল চক্রগুলো। অভিযোগ উঠেছে, অর্থের বিনিময়ে এই চক্রের মাধ্যমে নতুন করে বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গারা। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলো অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে তৎপর রয়েছে দাবি করলেও সম্প্রতি কত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে সে সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য কোনও কর্তৃপক্ষ দিতে পারেনি। গত কয়েক সপ্তাহে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক।

তারা জানান, প্রাণ বাঁচাতে তারা বাংলাদেশে এসেছেন। বর্ডার পার হতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের দালালকে টাকা দিতে হয়েছে। আর সীমান্তবর্তী স্থল এলাকা ও নাফ নদী পার করে নাইক্ষ্যংছড়ি, তুমব্রু ও টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ করছে তারা।

নাফ নদে রোহিঙ্গা পারাপারে দালাল চক্র গড়ে ওঠেছে বলে স্বীকার করেছেন টেকনাফের নৌ-পুলিশের ইনচার্জ পরিদর্শক তপন কুমার বিশ্বাস। তিনি জানান, ‘ মিয়ানমারে চলমান যুদ্ধের সুযোগে কয়েকটি দালাল চক্র রোহিঙ্গা পারাপারের বাণিজ্য গড়ে তোলার খবর আমরাও শুনেছি। আমরা সেসব দালালদের শনাক্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কাজ করছি। এছাড়া নাফ নদ দিয়ে যাতে কোনও অনুপ্রবেশের ঘটনা না ঘটে, সেজন্য টহল অব্যাহত রেখেছি। কিন্তু জনবল সংকটের পাশাপাশি নৌযান না থাকায় যখন-তখন অভিযানে নামতে পারি না।’

রাখাইন থেকে প্রথমে হেঁটে নাফ নদীর ওপারের তীরে আসে রোহিঙ্গারা। ওই নদীতীরে নৌকা নিয়ে বসে থাকে দালালেরা। এপারেও একইভাবে বাংলাদেশের টেকনাফ সীমান্তে থাকে দালালেরা। রাতে দুই অংশের দালালেরা টাকা নিয়ে রোহিঙ্গা ঢুকাচ্ছে বাংলাদেশে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দালালরা ২০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার বিনিময়ে উখিয়া-টেকনাফের সীমান্তে রাতের আঁধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে এ অবৈধ পাচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কাজে সীমান্তের অন্তত ২০ জনের বেশি নাম পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে- টেকনাফের বদি আলম, হেলাল উদ্দিন, মো. রহিম বাদশা, মো. বলি, নুর মোহাম্মদ, মোহাম্মদ শালমান, মো. শামসুল আলম, মো. জাবেদ, ইমান হোসেন ইউচুপ, মো. ইউনুছ, মো. সিরাজ, আজিজ উল্লাহ, জাফর আলম, মো. জিয়াবুল, মো. শফিক, মুহাম্মদ মান্নান, করিম উল্লাহ, নজির আহমেদ, মো. শফিক, মো. ফারুক, মো. জয়নাল, নুর হোসেন ও মো. সাদ্দাম প্রমুখ। পুলিশের মানবপাচার তালিকায়ও এদের নাম রয়েছে। আছে অনেকের নামে মানবপাচার আইনে মামলাও।

এসব দালাল ১৬টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসছে। পয়েন্টগুলো হলো- বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, তুমব্রু, ঘুমধুম, টেকনাফ সীমান্তের জাদিমুড়া, কেরুনতরী, বরইতলী, নাইট্যং, চৌধুরীপাড়া, মৌলভীপাড়া, নাজিরপাড়া, নয়াপাড়া, মেরিন ড্রাইভের খুরের মুখ, মহেষখালীয়াপাড়া, তুলাতুলি ঘাট ও শাহপরীর জালিয়াপাড়া ও গোলারচর। এসব পয়েন্ট একাধিক মানবপাচার মামলার দালালরা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

দালালের বিষয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘সীমান্তের এই পরিস্থিতিতে মধ্যস্থতাকারীদের (দালালদের) আবির্ভাব যেন না ঘটে সেজন্য গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সাধারণ মানুষদের সঙ্গে নিয়ে যাতে কোনও অনুপ্রবেশ না ঘটে, সেজন্য কাজ করছি। পাশাপাশি যদি এ ধরনের কোনও ঘটনা ঘটে, আমরা কঠোরভাবে প্রতিরোধ করবো।’

তবে টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, ‘নৌপথে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করে থাকে। বিশেষ করে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে রাতে ভারী বৃষ্টিতে। আমি জানতে পেরেছি, রোহিঙ্গাদের একটি অংশ মিয়ানমারের পাশে নাফ নদীর তীরে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছে।”

সম্প্রতি শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা এক স্বজনের সঙ্গে একটি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন মোহাম্মদ সাজে। মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে নৌকায় আরও ১২ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে তিনি বাংলাদেশে প্রবেশ করেন।

ওই রোহিঙ্গা তরুণ বলেন, “আমার বাড়ি বুথিডাংয়ে। সেখানে যুদ্ধে সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার বাবা মর্টার শেলের আঘাতে নিহত হয়েছেন। আরাকান আর্মি গ্রামে প্রবেশ করে এক ঘণ্টার মধ্যে সবাইকে গ্রামটি খালি করতে বলে। গ্রাম না ছাড়লে সবাইকে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেয়। কিছু খাবার নিয়ে আমরা গ্রাম ছেড়ে আসি।

তিনি আরও জানান, “৬০ জন যুবক আরাকান আর্মির হাতে ধরা পড়েছিল, আমি জানি না তাদের পরিণতি কী হয়েছে। পালানোর সময় আমি নিজের চোখে দেখেছি‑ অনেক যুবককে হত্যা করা হয়েছে। মংডুতে এসে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে আমরা তিন দিন আশ্রয় নেই। তারপর দালাল মোহাম্মদ ইউনুসের মাধ্যমে প্রত্যেকে চার লাখ কিয়াট দিয়ে পালিয়ে আসি।”

টেকনাফ সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের টহলের কারণে দুই দিন তাকে নৌকায় ভাসতে হয়েছে জানিয়ে সাজে বলেন, “প্রবল বর্ষণের মধ্যে এক রাতে আমরা গোলারচর এলাকা দিয়ে শাহপরীর দ্বীপে প্রবেশ করি। সে সময় তিনজন দালাল ছিলেন, আমি তাদের আগে কখনও দেখিনি।”

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া আরেক রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, “আমার গ্রামে হঠাৎ বোমা বিস্ফোরণ হয়। আমার পরিবারের ১৩ জন প্রাণ বাঁচাতে যে যার মতো পালিয়ে যায়। বাকিরা কোথায় আছে, কী অবস্থায় আছে আমি জানি না।”

তিনি বলেন, “আমরা দুই ভাই তিন দিন পাহাড়ি এলাকায় হেঁটে নদী পার হয়েছি। এই যাত্রায় আমাদের সঙ্গে অন্যান্য গ্রামের আরও সাতজন ছিলেন। পাহাড়ে ৪০ দিন থাকতে হয়েছে। খাবার ছিল না, পাতা খেয়ে বাঁচতে হয়েছে।”

“যেহেতু আমার দেশের পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে, কেউ এখানে (বাংলাদেশ) ঢুকেছে, আবার কেউ দালালের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছে,” বলেন তিনি।

ইউসুফ জানান, আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারগুলো তরুণদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, কারণ যুবকরাই আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। অনেকে এখানে পালিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করছে। কিন্তু নৌকা পারাপারের টাকার অভাবে তারা আসতে পারছে না।’

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের মতে, রাখাইনে দুই পক্ষের যুদ্ধে মংডু ও বুথিডংয়ে ৭০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা আটকা পড়েছে।

অনুপ্রবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কমান্ডার অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আমির জাফর বলেন, “গত কয়েক মাস ধরে মিয়ানমারের ভেতরে যুদ্ধ চলছে, ফলে সেখানে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা টিকে থাকতে না পেরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা এখানে (বাংলাদেশ) আসার চেষ্টা করছে, কেউ কেউ হয়তো ঢুকেছে। পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি।’

কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের নেতা মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, “আমরা যেভাবে জীবনযাপন করছি তা মোটেও ভালো নয়। তবে রাখাইনে রোহিঙ্গারা মৃত্যুর মুখোমুখি, তাই পালিয়ে এখানে নিরাপদ আশ্রয়ে আসার চেষ্টা করছে। এ সুযোগে দালালরা বাণিজ্যে করছে।’

গত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত টেকনাফের জেলেদের পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তবু অনেকে নৌকা নিয়ে সাগরে নামছে। মাছ ধরার নামে কৌশলে টাকার বিনিময়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা পারাপারের উদ্দেশ্যে সরকারি নির্দেশ অমান্য করে সাগরে নামছে দালাল চক্রের সদস্যরা।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) টেকনাফের সভাপতি জাবেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘দীর্ঘ দিন ধরে পার্শ্ববর্তী রাখাইনে যুদ্ধ চলছে। এতে সেখানে থাকা রোহিঙ্গারা এপারে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আবার এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা পারাপারের দালাল চক্র সক্রিয় হয়ে উঠছে। চক্রটি ২০১৭ সালেও রোহিঙ্গা পারাপারে লাখ টাকার বাণিজ্য করেছিল। এখনও সেই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। এসব দালালদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আবারও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামবে।’

এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা দোলোয়ার হোসেন বলেন, ‘অভিযানের পরও আমাদের অজান্তে কিছু নৌকা নামছে সেটা সত্য। কিন্তু এসব নৌকা রোহিঙ্গা পারাপার করছে কিনা সেটা বলা মুশকিল। তবে বিষয়টি উপজেলা আইনশৃঙ্খলা সভায় তুলে ধরবো।’

মিয়ানমার চলমান যুদ্ধে সীমান্তে যাতে কোনও অনুপ্রবেশ না ঘটে সেজন্য নাফ নদে টহল জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা। তিনি জানান, ‘ইতোমধ্যে কোনও রোহিঙ্গা ঢুকেছে কিনা সেটি অবগত নই। দালালের বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। সীমান্তে বিজিবি কাজ করছে।’

দালালের বিষয়ে বিজিবির পক্ষ থেকে কোনও বক্তব্য পাওয়া না গেলেও সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকানার পাশাপাশি যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিজিবি সদস্যরা প্রস্তুত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ।

এদিকে, গত ২২ জুন বাংলাদেশে প্রবেশের সময় একই সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে আরেক রোহিঙ্গা যুবক মো. আনোয়ার পা হারান। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এছাড়া গত ৬ জুলাই নাফ নদে কাঁকড়া শিকারে গিয়ে তিন রোহিঙ্গা হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

ট্যাগ :
পাঠকপ্রিয়

চকরিয়ায় বসতভিটা ও দোকান দখলের জন্য হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট: আহত ৫

সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা, সক্রিয় দালাল চক্র

প্রকাশিত সময় : ০৯:০৫:৩০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৫ জুলাই ২০২৪

নাফ নদীর এক পাড়ে কক্সবাজারের টেকনাফ অন্য পাড়ে রাখাইনের মংডু শহর। এই নদী বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত। নাফের ওপাড়ে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর চলমান যুদ্ধাবস্থার মধ্যেই তৎপর হয়ে উঠেছে দুই দেশের রোহিঙ্গা পারাপারের দালাল চক্রগুলো। অভিযোগ উঠেছে, অর্থের বিনিময়ে এই চক্রের মাধ্যমে নতুন করে বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গারা। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলো অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে তৎপর রয়েছে দাবি করলেও সম্প্রতি কত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে সে সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য কোনও কর্তৃপক্ষ দিতে পারেনি। গত কয়েক সপ্তাহে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক।

তারা জানান, প্রাণ বাঁচাতে তারা বাংলাদেশে এসেছেন। বর্ডার পার হতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের দালালকে টাকা দিতে হয়েছে। আর সীমান্তবর্তী স্থল এলাকা ও নাফ নদী পার করে নাইক্ষ্যংছড়ি, তুমব্রু ও টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ করছে তারা।

নাফ নদে রোহিঙ্গা পারাপারে দালাল চক্র গড়ে ওঠেছে বলে স্বীকার করেছেন টেকনাফের নৌ-পুলিশের ইনচার্জ পরিদর্শক তপন কুমার বিশ্বাস। তিনি জানান, ‘ মিয়ানমারে চলমান যুদ্ধের সুযোগে কয়েকটি দালাল চক্র রোহিঙ্গা পারাপারের বাণিজ্য গড়ে তোলার খবর আমরাও শুনেছি। আমরা সেসব দালালদের শনাক্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কাজ করছি। এছাড়া নাফ নদ দিয়ে যাতে কোনও অনুপ্রবেশের ঘটনা না ঘটে, সেজন্য টহল অব্যাহত রেখেছি। কিন্তু জনবল সংকটের পাশাপাশি নৌযান না থাকায় যখন-তখন অভিযানে নামতে পারি না।’

রাখাইন থেকে প্রথমে হেঁটে নাফ নদীর ওপারের তীরে আসে রোহিঙ্গারা। ওই নদীতীরে নৌকা নিয়ে বসে থাকে দালালেরা। এপারেও একইভাবে বাংলাদেশের টেকনাফ সীমান্তে থাকে দালালেরা। রাতে দুই অংশের দালালেরা টাকা নিয়ে রোহিঙ্গা ঢুকাচ্ছে বাংলাদেশে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দালালরা ২০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার বিনিময়ে উখিয়া-টেকনাফের সীমান্তে রাতের আঁধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে এ অবৈধ পাচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কাজে সীমান্তের অন্তত ২০ জনের বেশি নাম পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে- টেকনাফের বদি আলম, হেলাল উদ্দিন, মো. রহিম বাদশা, মো. বলি, নুর মোহাম্মদ, মোহাম্মদ শালমান, মো. শামসুল আলম, মো. জাবেদ, ইমান হোসেন ইউচুপ, মো. ইউনুছ, মো. সিরাজ, আজিজ উল্লাহ, জাফর আলম, মো. জিয়াবুল, মো. শফিক, মুহাম্মদ মান্নান, করিম উল্লাহ, নজির আহমেদ, মো. শফিক, মো. ফারুক, মো. জয়নাল, নুর হোসেন ও মো. সাদ্দাম প্রমুখ। পুলিশের মানবপাচার তালিকায়ও এদের নাম রয়েছে। আছে অনেকের নামে মানবপাচার আইনে মামলাও।

এসব দালাল ১৬টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসছে। পয়েন্টগুলো হলো- বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, তুমব্রু, ঘুমধুম, টেকনাফ সীমান্তের জাদিমুড়া, কেরুনতরী, বরইতলী, নাইট্যং, চৌধুরীপাড়া, মৌলভীপাড়া, নাজিরপাড়া, নয়াপাড়া, মেরিন ড্রাইভের খুরের মুখ, মহেষখালীয়াপাড়া, তুলাতুলি ঘাট ও শাহপরীর জালিয়াপাড়া ও গোলারচর। এসব পয়েন্ট একাধিক মানবপাচার মামলার দালালরা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

দালালের বিষয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘সীমান্তের এই পরিস্থিতিতে মধ্যস্থতাকারীদের (দালালদের) আবির্ভাব যেন না ঘটে সেজন্য গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সাধারণ মানুষদের সঙ্গে নিয়ে যাতে কোনও অনুপ্রবেশ না ঘটে, সেজন্য কাজ করছি। পাশাপাশি যদি এ ধরনের কোনও ঘটনা ঘটে, আমরা কঠোরভাবে প্রতিরোধ করবো।’

তবে টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, ‘নৌপথে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করে থাকে। বিশেষ করে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে রাতে ভারী বৃষ্টিতে। আমি জানতে পেরেছি, রোহিঙ্গাদের একটি অংশ মিয়ানমারের পাশে নাফ নদীর তীরে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছে।”

সম্প্রতি শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা এক স্বজনের সঙ্গে একটি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন মোহাম্মদ সাজে। মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে নৌকায় আরও ১২ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে তিনি বাংলাদেশে প্রবেশ করেন।

ওই রোহিঙ্গা তরুণ বলেন, “আমার বাড়ি বুথিডাংয়ে। সেখানে যুদ্ধে সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার বাবা মর্টার শেলের আঘাতে নিহত হয়েছেন। আরাকান আর্মি গ্রামে প্রবেশ করে এক ঘণ্টার মধ্যে সবাইকে গ্রামটি খালি করতে বলে। গ্রাম না ছাড়লে সবাইকে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেয়। কিছু খাবার নিয়ে আমরা গ্রাম ছেড়ে আসি।

তিনি আরও জানান, “৬০ জন যুবক আরাকান আর্মির হাতে ধরা পড়েছিল, আমি জানি না তাদের পরিণতি কী হয়েছে। পালানোর সময় আমি নিজের চোখে দেখেছি‑ অনেক যুবককে হত্যা করা হয়েছে। মংডুতে এসে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে আমরা তিন দিন আশ্রয় নেই। তারপর দালাল মোহাম্মদ ইউনুসের মাধ্যমে প্রত্যেকে চার লাখ কিয়াট দিয়ে পালিয়ে আসি।”

টেকনাফ সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের টহলের কারণে দুই দিন তাকে নৌকায় ভাসতে হয়েছে জানিয়ে সাজে বলেন, “প্রবল বর্ষণের মধ্যে এক রাতে আমরা গোলারচর এলাকা দিয়ে শাহপরীর দ্বীপে প্রবেশ করি। সে সময় তিনজন দালাল ছিলেন, আমি তাদের আগে কখনও দেখিনি।”

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া আরেক রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, “আমার গ্রামে হঠাৎ বোমা বিস্ফোরণ হয়। আমার পরিবারের ১৩ জন প্রাণ বাঁচাতে যে যার মতো পালিয়ে যায়। বাকিরা কোথায় আছে, কী অবস্থায় আছে আমি জানি না।”

তিনি বলেন, “আমরা দুই ভাই তিন দিন পাহাড়ি এলাকায় হেঁটে নদী পার হয়েছি। এই যাত্রায় আমাদের সঙ্গে অন্যান্য গ্রামের আরও সাতজন ছিলেন। পাহাড়ে ৪০ দিন থাকতে হয়েছে। খাবার ছিল না, পাতা খেয়ে বাঁচতে হয়েছে।”

“যেহেতু আমার দেশের পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে, কেউ এখানে (বাংলাদেশ) ঢুকেছে, আবার কেউ দালালের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছে,” বলেন তিনি।

ইউসুফ জানান, আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারগুলো তরুণদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, কারণ যুবকরাই আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। অনেকে এখানে পালিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করছে। কিন্তু নৌকা পারাপারের টাকার অভাবে তারা আসতে পারছে না।’

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের মতে, রাখাইনে দুই পক্ষের যুদ্ধে মংডু ও বুথিডংয়ে ৭০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা আটকা পড়েছে।

অনুপ্রবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কমান্ডার অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আমির জাফর বলেন, “গত কয়েক মাস ধরে মিয়ানমারের ভেতরে যুদ্ধ চলছে, ফলে সেখানে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা টিকে থাকতে না পেরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা এখানে (বাংলাদেশ) আসার চেষ্টা করছে, কেউ কেউ হয়তো ঢুকেছে। পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি।’

কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের নেতা মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, “আমরা যেভাবে জীবনযাপন করছি তা মোটেও ভালো নয়। তবে রাখাইনে রোহিঙ্গারা মৃত্যুর মুখোমুখি, তাই পালিয়ে এখানে নিরাপদ আশ্রয়ে আসার চেষ্টা করছে। এ সুযোগে দালালরা বাণিজ্যে করছে।’

গত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত টেকনাফের জেলেদের পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তবু অনেকে নৌকা নিয়ে সাগরে নামছে। মাছ ধরার নামে কৌশলে টাকার বিনিময়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা পারাপারের উদ্দেশ্যে সরকারি নির্দেশ অমান্য করে সাগরে নামছে দালাল চক্রের সদস্যরা।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) টেকনাফের সভাপতি জাবেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘দীর্ঘ দিন ধরে পার্শ্ববর্তী রাখাইনে যুদ্ধ চলছে। এতে সেখানে থাকা রোহিঙ্গারা এপারে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আবার এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা পারাপারের দালাল চক্র সক্রিয় হয়ে উঠছে। চক্রটি ২০১৭ সালেও রোহিঙ্গা পারাপারে লাখ টাকার বাণিজ্য করেছিল। এখনও সেই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। এসব দালালদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আবারও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামবে।’

এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা দোলোয়ার হোসেন বলেন, ‘অভিযানের পরও আমাদের অজান্তে কিছু নৌকা নামছে সেটা সত্য। কিন্তু এসব নৌকা রোহিঙ্গা পারাপার করছে কিনা সেটা বলা মুশকিল। তবে বিষয়টি উপজেলা আইনশৃঙ্খলা সভায় তুলে ধরবো।’

মিয়ানমার চলমান যুদ্ধে সীমান্তে যাতে কোনও অনুপ্রবেশ না ঘটে সেজন্য নাফ নদে টহল জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা। তিনি জানান, ‘ইতোমধ্যে কোনও রোহিঙ্গা ঢুকেছে কিনা সেটি অবগত নই। দালালের বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। সীমান্তে বিজিবি কাজ করছে।’

দালালের বিষয়ে বিজিবির পক্ষ থেকে কোনও বক্তব্য পাওয়া না গেলেও সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকানার পাশাপাশি যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিজিবি সদস্যরা প্রস্তুত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ।

এদিকে, গত ২২ জুন বাংলাদেশে প্রবেশের সময় একই সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে আরেক রোহিঙ্গা যুবক মো. আনোয়ার পা হারান। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এছাড়া গত ৬ জুলাই নাফ নদে কাঁকড়া শিকারে গিয়ে তিন রোহিঙ্গা হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।