১২:২৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এবার মামলার প্রস্তুতি, দায়ী মনে করছে হাসিনাকেও

শয়নকক্ষের দেয়ালে দেয়ালে আহাজারি-আর্তনাদের ছায়া। কোথাও লেখা ‘মানুষ মানুষকে গুলি করে মারে’, আবার কোথাও ‘নির্দোষ মানুষ কেন মরে?”, কোনো দেয়ালে ঝুলছে ‘আব্বু তুমি বাড়িতে করে আসবা’ লেখাসংবলিত ওয়ালমেট, এক পাশে স্থান পেয়েছে ‘আমাদের আব্বু হত্যার কি কোনো বিচার পাব না?”

এ রকম চরম অসহায়ত্বের কথাগুলো ফুটে উঠেছে ২০১৮ সালের ২৬ মে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত কক্সবাজারের টেকনাফ পৌর কাউন্সিলর মোহাম্মদ একরামুল হকের ঘরে। তখন তাঁর হত্যার বিচার চাইতে পারেননি পরিবারের সদস্যরা, এমনকি চিৎকার করে কাঁদতেও পারেননি। তবে হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তা লিখে রেখেছেন একরামের মেয়েরা।

সেই সময় একরাম হত্যার পর একটি অডিও ক্লিপ প্রকাশ করে তাঁর পরিবার। যা নাড়িয়ে দেয় সারাদেশ, এমনকি বিশ্বের সব বিবেকবান মানুষকে। একরামের প্যান্টের পকেটে থাকা ফোনে মেয়ে কল দিলে চাপ লেগে রিসিভ হয়ে যায়। এতে সেই মুহূর্তের অনেক কথা রেকর্ড হয়ে যায় নিহতের স্ত্রীর মোবাইল ফোনে। এ সময় তাঁর এক মেয়ে বলেন, ‘আব্বু, তুমি কানতেছ যে।’ এর পর শোনা যায় গুলির শব্দ, শোরগোল।

গত ৫ আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর আশান্বিত হয়েছে অসহায় পরিবারটি। ভরসা পাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ওপর, বিচার পাওয়ার জন্য বসছেন নড়েচড়ে।

ইতোমধ্যে মামলার প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নিহতের স্ত্রী আয়েশা বেগম।
তিনি বলেন, ‘এতদিন ভয়ে বিচার চাইতে পারিনি। এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ঘাতকদের শাস্তি চাই। একরাম মাদকের সঙ্গে কখনও জড়িত ছিলেন না, তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে ফাঁসানো হয়। তাঁর কোনো অপরাধ ছিল না। সে সময় মানুষের জীবনের কোনো মূল্য ছিল না। সেই থেকে ছয়টি বছর কেটে গেছে, ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা, কেউ খোঁজ নিতেও আসেনি। নতুন সরকারের কাছে ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি। শেখ হাসিনা এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।’

আয়েশা বেগম বলেন, ‘স্বামী মারা গেছে ছয় বছর দুই মাসের বেশি হয়েছে। এখনও বিচারের অপেক্ষায় প্রহর গুনছি। তখন মামলা করতে পারিনি বিভিন্ন হুমকির কারণে। আমি এই সরকারের সহায়তা চাই, যাতে দ্রুত স্বামী হত্যার মামলা করতে পারি। বর্তমানে দুই মেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে দিন পার করছি। বৃষ্টি হলে পানির জন্য ঘুমানো কষ্টকর। সন্তানের লেখাপাড়ার খরচও চালাতে পারছি না।’

তিনি বলেন, ‘একরামকে হত্যার পর আমরা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলায়, মামলা করতে চাওয়ায় পরিবারকে অনেক হয়রানির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। বিচার চেয়ে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ চাইলে, তখন সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ফোন করে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেন। তারা ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুই হয়নি। বিষয়টি নিয়ে দেশজুড়ে সমালো চনার ঝড় উঠলেও কোনো পদক্ষেপ নেননি শেখ হাসিনা। তিনি কীভাবে এ হত্যার দায় এড়াবেন? তৎকালীন র্যাব এবং ডিজিএফআইয়ের কর্মক- তাদের আইনের আওতায় আনলেই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হবে।’

স্মৃতিচারণ করে জলভরা চোখে আয়েশা বলেন, “হত্যার পর ঘটনাস্থল থেকে কুড়িয়ে পাওয়া একরামের চশমাটি এক বৃদ্ধ লোক বাসায় দিয়ে যান। সেই চশমায় এখনও রক্তের দাগ আছে। এর চেয়ে বেদনার কী হতে পারে? প্রতিদিন স্বামীসহ আমরা চারজন একসঙ্গে খেতে বসতাম। কিন্তু এখন খাওয়ার সময় তাঁর কথা খুব মনে পড়ে, দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে। তাঁর পছন্দের খাবারগুলো রান্না করলে কান্না আসে। এমনকি মেয়েরাও তাদের বাবার পছন্দের কোনো খাবার রান্না করলে কষ্ট পায়, খেতে চায় না।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘মিথ্যা’ বয়ান প্রচার করার দায়ে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদেরও বিচার চান আয়েশা। তিনি বলেন, সরকারের কাছে এ দাবি জানাই, সবকিছু যেন নতুনভাবে তদন্ত করা হয়। মামলার ব্যাপারে সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি।’

ট্যাগ :
পাঠকপ্রিয়

আইন শৃঙ্খলা, দ্রব্যমুল্য, সংস্কার বিষয়ে সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ- ধর্ম উপদেষ্টা

এবার মামলার প্রস্তুতি, দায়ী মনে করছে হাসিনাকেও

প্রকাশিত সময় : ১২:১৯:০৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ অগাস্ট ২০২৪

শয়নকক্ষের দেয়ালে দেয়ালে আহাজারি-আর্তনাদের ছায়া। কোথাও লেখা ‘মানুষ মানুষকে গুলি করে মারে’, আবার কোথাও ‘নির্দোষ মানুষ কেন মরে?”, কোনো দেয়ালে ঝুলছে ‘আব্বু তুমি বাড়িতে করে আসবা’ লেখাসংবলিত ওয়ালমেট, এক পাশে স্থান পেয়েছে ‘আমাদের আব্বু হত্যার কি কোনো বিচার পাব না?”

এ রকম চরম অসহায়ত্বের কথাগুলো ফুটে উঠেছে ২০১৮ সালের ২৬ মে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত কক্সবাজারের টেকনাফ পৌর কাউন্সিলর মোহাম্মদ একরামুল হকের ঘরে। তখন তাঁর হত্যার বিচার চাইতে পারেননি পরিবারের সদস্যরা, এমনকি চিৎকার করে কাঁদতেও পারেননি। তবে হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তা লিখে রেখেছেন একরামের মেয়েরা।

সেই সময় একরাম হত্যার পর একটি অডিও ক্লিপ প্রকাশ করে তাঁর পরিবার। যা নাড়িয়ে দেয় সারাদেশ, এমনকি বিশ্বের সব বিবেকবান মানুষকে। একরামের প্যান্টের পকেটে থাকা ফোনে মেয়ে কল দিলে চাপ লেগে রিসিভ হয়ে যায়। এতে সেই মুহূর্তের অনেক কথা রেকর্ড হয়ে যায় নিহতের স্ত্রীর মোবাইল ফোনে। এ সময় তাঁর এক মেয়ে বলেন, ‘আব্বু, তুমি কানতেছ যে।’ এর পর শোনা যায় গুলির শব্দ, শোরগোল।

গত ৫ আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর আশান্বিত হয়েছে অসহায় পরিবারটি। ভরসা পাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ওপর, বিচার পাওয়ার জন্য বসছেন নড়েচড়ে।

ইতোমধ্যে মামলার প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নিহতের স্ত্রী আয়েশা বেগম।
তিনি বলেন, ‘এতদিন ভয়ে বিচার চাইতে পারিনি। এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ঘাতকদের শাস্তি চাই। একরাম মাদকের সঙ্গে কখনও জড়িত ছিলেন না, তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে ফাঁসানো হয়। তাঁর কোনো অপরাধ ছিল না। সে সময় মানুষের জীবনের কোনো মূল্য ছিল না। সেই থেকে ছয়টি বছর কেটে গেছে, ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা, কেউ খোঁজ নিতেও আসেনি। নতুন সরকারের কাছে ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি। শেখ হাসিনা এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।’

আয়েশা বেগম বলেন, ‘স্বামী মারা গেছে ছয় বছর দুই মাসের বেশি হয়েছে। এখনও বিচারের অপেক্ষায় প্রহর গুনছি। তখন মামলা করতে পারিনি বিভিন্ন হুমকির কারণে। আমি এই সরকারের সহায়তা চাই, যাতে দ্রুত স্বামী হত্যার মামলা করতে পারি। বর্তমানে দুই মেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে দিন পার করছি। বৃষ্টি হলে পানির জন্য ঘুমানো কষ্টকর। সন্তানের লেখাপাড়ার খরচও চালাতে পারছি না।’

তিনি বলেন, ‘একরামকে হত্যার পর আমরা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলায়, মামলা করতে চাওয়ায় পরিবারকে অনেক হয়রানির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। বিচার চেয়ে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ চাইলে, তখন সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ফোন করে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেন। তারা ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুই হয়নি। বিষয়টি নিয়ে দেশজুড়ে সমালো চনার ঝড় উঠলেও কোনো পদক্ষেপ নেননি শেখ হাসিনা। তিনি কীভাবে এ হত্যার দায় এড়াবেন? তৎকালীন র্যাব এবং ডিজিএফআইয়ের কর্মক- তাদের আইনের আওতায় আনলেই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হবে।’

স্মৃতিচারণ করে জলভরা চোখে আয়েশা বলেন, “হত্যার পর ঘটনাস্থল থেকে কুড়িয়ে পাওয়া একরামের চশমাটি এক বৃদ্ধ লোক বাসায় দিয়ে যান। সেই চশমায় এখনও রক্তের দাগ আছে। এর চেয়ে বেদনার কী হতে পারে? প্রতিদিন স্বামীসহ আমরা চারজন একসঙ্গে খেতে বসতাম। কিন্তু এখন খাওয়ার সময় তাঁর কথা খুব মনে পড়ে, দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে। তাঁর পছন্দের খাবারগুলো রান্না করলে কান্না আসে। এমনকি মেয়েরাও তাদের বাবার পছন্দের কোনো খাবার রান্না করলে কষ্ট পায়, খেতে চায় না।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘মিথ্যা’ বয়ান প্রচার করার দায়ে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদেরও বিচার চান আয়েশা। তিনি বলেন, সরকারের কাছে এ দাবি জানাই, সবকিছু যেন নতুনভাবে তদন্ত করা হয়। মামলার ব্যাপারে সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি।’