০১:৫৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রোহিঙ্গা সংকটের ৭ বর্ষ পার: বাড়ছে রোহিঙ্গা: বাড়ছে অপরাধ: স্থানীয়দের উপর নিদারুণ প্রভাব

  • শ.ম.গফুর:
  • প্রকাশিত সময় : ১২:৫৭:৪১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৪
  • ৬২ ভিউ

মিয়ানমারের বলপুর্বক বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের এপারে আগমনের সাত বছর পেরিয়ে অষ্টম বর্ষে পা রেখেছে।মানবিক বিবেচনায় আশ্রয় দেওয়া রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরাতে নানা কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্যেও আলোর মুখ দেখেনি প্রত্যাবাসন। ফলে রোহিঙ্গা সংকট দিন-দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। ক্যাম্পের এসব শরণার্থীদের তিন বেলা খাবারও জুটছে না।পুষ্টিহীনতায় ভুগছে শিশুরা। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে গড়ে আরোও নব্বইজন করে শিশু। যার ফলে গত ৭ বছরে ক্যাম্পে নতুন করে প্রায় দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বেড়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক অর্থ সহায়তা বাড়েনি,বরং কমছে।অনুদান কমে যাওয়ায় উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের মাসিক খাদ্য ভাউচার ৩ মাসের মধ্যে ২বার কমাতে হয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের দৈনিক রেশন ৩৩ শতাংশ কমে গেছে। শুরুতেই প্রতিমাসে তাদের দেয়া হতো জনপ্রতি ১২ ডলারের খাদ্য সহায়তা। এরপর এটা কমিয়ে করা হয়েছে ১০ ডলার। আর এখন দেয়া হচ্ছে ৮ ডলারের খাবার। রেশন কমিয়ে দেয়ায় রোহিঙ্গাদের মধ্য হতাশা ও ক্ষোভ বেড়েছে। ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা বলছেন তাদের ৮ ডলার।বা বাংলাদেশি ৯০০ টাকার খাবার দেয়া হচ্ছে।

যা দিয়ে ৩ বেলা তো দূরে থাক, একবেলাও তারা পেট ভরে খেতে পারছেন না। ভালো খাবারতো তাদের ভাগ্যেই জুটে না।পেটের দায়ে অনেক রোহিঙ্গা কাজের সন্ধানে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় ভাবে টেকনাফ বন্দরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা পরিচয় গোপন রেখে স্বল্প মজুরিতে দিনমজুরের কাজ করছে।এতে স্থানীয় জনগনের উপর ঋণাত্মক প্রভাব তৈরি করছে।যা,স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা শুধু নয়,নেতিবাচক প্রচাব ফেলেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারি গোয়েন লুইস সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন যে,বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের খাদ্য সাহায্য কমাতে বাধ্য হচ্ছে। এতে তাদের স্বাস্থ্য, পুষ্টির ফলাফল হবে ভয়াবহ।নারী, শিশু ও সবচেয়ে নাজুক মানুষগুলো বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এমনি পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের জন্য জরুরি অর্থায়নের আহবান জানিয়েছেন জাতিসংঘের দাতাদেশ ও সংস্থা গুলো সাহায্য সংগ্রহে তৎপরতা অব্যাহত রাখলেও আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছে না। তাই বাংলাদেশকে বাধ্য হয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে ৭০ কোটি ডলার ঋণ ও অনুদান নিতে হচ্ছে।

এর মধ্যে ৫৪ কোটি ডলার ঋণ এবং ১৬ কোটি ডলার অনুদান।বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ এবং আর্থিক সহায়তা কমানোতে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হচ্ছে।গত এক বছরে সরকারের খরচ হয়েছে ১৭০কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৭ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। এতথ্য ত্রান ও পূর্ণবাসন মন্ত্রনালয়ের। বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ যত খরচ করছে তার ৫০ শতাংশেরও জোগান দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হিমশিম খাচ্ছে।

তিন হাজার ডলারেরও কম মাথাপিছু আয়ের একটি দেশ বছরে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করছে নিজের পকেট থেকে। এক্ষেত্রে দাতাগোষ্ঠীকে আরো এগিয়ে আসা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন।বিগত ২০১৭ সালে নতুন করে প্রায় ১০ লাখের বেশী রোহিঙ্গারা আগমন ঘটে।পুর্বের আশ্রিত সহ সব মিলিয়ে ১২ লাখের বেশী রোহিঙ্গার বসবাস এদেশে।আবার নতুন করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন ৯০টি শিশু জন্ম নিচ্ছে। গত ৭ বছরের জন্ম নিয়েছে প্রায় ২ লাখের বেশী শিশু। যদিও নিবন্ধন হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার শিশুর। ফলে ক্যাম্পে দিন দিন বাড়ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, বাড়ছে তাদের চাহিদাও। রোহিঙ্গাদের উর্ধ্বমুখী জন্মহার বাংলাদেশের জন্য যেমন মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যাম্পে যত শিশু বাড়ছে, ততই রোহিঙ্গা শিশুদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এদের বড় হতে হচ্ছে ক্যাম্পের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও চরম পুষ্টিহীনতার মধ্যে। ক্যাম্পে তাদের জন্য বিভিন্ন এনজিও উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করলেও সেটি হচ্ছে সীমিত পরিসরে।

রোহিঙ্গা ভাষায় পর্যাপ্ত বই নেই। এখানকার স্কুলে বাংলা ভাষায় না পড়াতে বারণ রয়েছে।এতে কাউকে পড়ানোর হয় না। রোহিঙ্গা ভাষা ও ইংরেজী ভাষায় তাঁদের পাঠদান করা হয়। ডেনিশ রিফিউজিম কাউন্সিল নামে একটি এনজিওতে কাজ করেন আবু তাহের। তিনি সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে জানান, এখানকার শিশুরা খুবই অবহেলিত। তারা ভালো খাবার পায় না। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ না থাকায় তারা সর্দি কাশি, জ্বর, ডায়রিয়া ও নিমোনিয়া জনিত রোগ-শোকে ভোগে থাকেন।পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সুত্র জানায়, রোহিঙ্গারা জন্ম নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে মোটেও পরিচিত নন।তাই এব্যাপারে মোটেই আগ্রহী নয় তারা। তাদের সচেতন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ মনে করে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পাপ,এমন নেতিবাচক ধারণা কু-সংস্কারের জন্ম দিচ্ছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে সচেতন করতে ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৩৫টি এনজিও’র সাড়ে তিন হাজার কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মী কাজ করছেন। ইসলামের আলোকে জন্ম নিয়ন্ত্রণে সচেতন করতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন স্থানীয় মসজিদগুলোর মাধ্যমে কাজ চালাচ্ছে।এরফলে এখন অনেকেই জন্মনিয়ন্ত্রণে আগ্রহী হচ্ছেন। এই কর্মসূচি কার্যকর করতে হলে বিনাখরচে তাদের কনডম ও পিল দিতে হবে।

কারণ যেখানে ঠিকমতো তিন বেলা ভাত জুটছে না, সেখানে রোহিঙ্গারা টাকা খরচ করে এসব কিনতে আগ্রহী নন।বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতিসংঘের মাধ্যমে প্রত্যেক সাবালকদের ২টির বেশি সন্তান নেয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করলে জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম অত্যধিক কার্যকর হতো। এরই মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাতিসংঘকে কে পরিবার পরিকল্পনায় জোর দেয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়।শরণার্থী বিষয়ক এক সভায় বাংলাদেশের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে জন্মনিয়ন্ত্রনে জোর দেয়ার আহবান জানিয়েছিলেন।

তিনি ওই সময় দাবি করছিলেন যে, আশ্রয় গেঁড়ে প্রতি বছর ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিচ্ছে। এতে প্রায় ৭ বছর কাছাকাছি সময়ে বছরের নিবন্ধন মতে দেড় লাখের বেশী শিশু অটোমোটিক বেড়ে গেছে। এ সংখ্যা আরো বেশী ছাড়িয়ে যাবে। এটাকে বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন,এটা ট্যাকেল দেযার জন্য সব ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে।ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফ ও সেভ দ্যা চিলড্রেনের পরিসংখ্যান জানায়,বর্তমানে প্রতিদিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যুক্ত হচ্ছে প্রায় ৯০ জন শিশু। ফলে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ। এতে স্থানীয় জনগণের মধ্যে চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। কারণ যেভাবে রোহিঙ্গার সংখ্যা বাড়ছে এভাবে বাড়তে থাকলে শুধু টেফনাফ ও উখিয়া নয়, পুরো কক্সবাজার জেলা জুড়ে স্থানীয় অধিবাসীরা সংখ্যা লঘু হয়ে পড়বে।

এমন আশংকা উড়ে দেওয়া যায় না। তাছাড়া বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে উখিয়ায় ও টেকনাফে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ চাহিদার তুলনায় সেখানে সব্জী, মাছ, মাংসসহ নিত্যপণ্যের সরবরাহ কম। তাই এখানে নিত্যপণ্য বিশেষ করে শাক সবজি, মাছ মাংসের দাম আকাশ ছোঁয়া। স্থানীয়রা মনে করছেন বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কারণে তাদের নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে এ বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। আগে এই দুই উপজেলায় যে পরিমাণ শাক সবজি ও মাছ উৎপাদন হতো, তাতে স্থানীদের চাহিদা পূরণ হয়ে আরো উদ্বৃদ্ধ থাকতো। যেগুলো কৃষকরা বাইরে বিক্রি করতেন।

রোহিঙ্গাদের জায়গা দিতে গিয়ে এখন জমি কমে যাওয়ায় উৎপাদনতো কমেছেই, চাহিদা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ বেশি। ফলে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে স্থানীয়রা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না শুধু চরম ক্রান্তিকাল পার করছেন বললেই চলে।দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে স্থানীয় দরিদ্র লোকজনদের। একই ভাবে শ্রম বাজার আস্তে আস্তে রোহিঙ্গাদের দখলে চলে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে।দেখা দিচ্ছে চরম বিপর্যয়।এ ছাড়াও টেনাফ ও উখিয়ার বাসিন্দরা বাইরে বের হলে বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রামে যাওয়ার সময় তাদের নানা ঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে। তল্লাশীর সময় তাদের প্রমাণ করতে হয় তারা রোহিঙ্গা নন। পাসপোর্ট বানাতে কিংবা বিদেশ যেতে গেলে তাদের নানাভাবে হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে।রোহিঙ্গাদের মধ্যে আর্থিক অবস্থা ভালো, তারা দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশের এনআইডি কার্য ও পাসপোর্ট বানিয়ে নিচ্ছে। আর এ পাসপোর্ট তৈরির জন্য তারা দেশের বিভিন্ন স্থানের ঠিকানা ব্যবহার করছে।রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট ও এআইডি করে দেয়ার অভিযোগে সম্প্রতি ২৩ জনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ।গ্রেফতারকৃত দালালদের মোবাইলে শত শত পাসপোর্ট করে দেয়ার প্রাসঙ্গিক সফট ডকুমেন্টস, ডেলিভারি স্লিপ পাওয়া গেছে। যার মধ্যে গত ৫ মাসে রোহিঙ্গাদের জন্য করা প্রায় দেড়শোটি পাসপোর্ট ইতোমধ্যে তারা সরবরাহ করেছে।উখিয়ায় ও টেকনাফে এখনো তৈরি হচ্ছে রোহিঙ্গা বসতি।নতুন করে বিচ্ছিন্ন ভাবে দালাল চক্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ঢুকছে। এর ফলে কৃষি জমি, পাহাড়, বন ও জীবনবৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

রোহিঙ্গারা যে সব এলাকায় বসবাস করছে, সেসব এলাকা ও আশপাশে টেকনাফ ও উখিয়ার.বহু পরিবার কৃষি কাজ ও মাছ ধরার পেশার নিয়োজিত ছিল। কিন্তু এখন কৃষি জমির বিশাল অংশে রোহিঙ্গাদের বর্জ্য আর্বজনা ফেলছে। ফলে বহু ফসলি জমি ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়ে চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এতে স্থানীয়দের অনেকেই বেকার হয়ে পড়েছেন।টেকনাফ ও উখিযায় এক সময় ছিল সবুজের সমারোহ। প্রচুর গাছপালা ছিল। এখন সেখানে সবুজ নেই,আছে অগণন ছোট খুপরি ঘর। জ্বালানির প্রয়োজনে গাছ কেটে সাবাড় করে ফেলা হচ্ছে।রোহিঙ্গাদের বসতির কারণে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ নিয়ন্ত্রণাধীন উখিয়া ও টেকনাফে ১২ হাজার একর বনভূমি ধ্বংস হয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ২ লাখ ১২ হাজার ৬০৭টি গোসলখানা, ত্রাণ সংরক্ষণের জন্য ২০টি অস্থায়ী গুদাম, ১৩ কিলোমিটার বিদ্যুতের লাইন, ৩০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ এবং ২০ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। এতে ২ হাজার ২৩১ কোটি টাকার বন ধ্বংস হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে সেখানকার পরিবেশ, বন ও জীব বৈচিত্র্য। এ ছাড়াও এক সময় এ অঞ্চল দিয়ে এশিয়ান হাতির আবাস্থল ও বিচরণক্ষেত্র ছিল।

এখন আর সেখানে হাতি খুব একটা দেখা যায় না। এক সময় এই উখিয়া ও টেকনাফ ছিল শান্তির জনপদ। এখানে প্রচুর ফসল হতো। শাক-সবজি, ধান হতো, সুপারি হতো, হতো প্রচুর কাঠ। মানুষ বেশ সুখের ছিল। সাড়ে ১৪ লাখ রোহিঙ্গাকে জায়গা দিতে গিয়ে উখিয়া ও টেকনাফের বাসিন্দাদের শান্তি কেড়ে নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সুত্র মতে, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে ৩২টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয়। এসব গ্রুপের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড দিন দিন বেড়েই চলছে। একই সঙ্গে ইয়াবা ও আইস,মাদক ও চোরাই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপে দেখা যায় উখিয়ায় মোট জনসংখ্যা ২ লাখ ৬৩ হাজার ১৮৬ জন এবং টেকনাফে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮৬৩ জন। অর্থাৎ দুই উপজেলা স্থানীয় জনসংখ্যা হচ্ছে ৫ লাখ ৫৭ হাজার ৪৯ জন। আর এই দুই উপজেলায় রোহিঙ্গা রয়েছেন সাড়ে ১৪ লাখ। যা,দুই থানায় স্থানীয় জনগণের চেয়ে প্রায় আড়াইগুণ বেশি। ফলে এখানে স্থানীয়রা সংখ্যালগুতে পরিণত হয়েছে।

এদিকে কক্সবাজার জেলায় ৯টি উপজেলায় মোট জনসংখ্যা ২৮ লাখ ৯৩ হাজার ২৬৫ জন। আর কক্সবাজারে রোহিঙ্গা রয়েছে সাড়ে ১৪ লাখ। যেভাবে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বাড়ছে এক সময় কক্সবাজার জেলায় স্থানীয়রা সংখ্যা লঘুতে পরিণত হতে পারে বলে আশংকা করছেন অনেকেই।এদিকে উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দারা রোহিঙ্গাদের কারণে নিজেদের অস্তিত্ব ও ভবিষ্যতে নিয়ে উদ্বিগ্ন। একটানা ৭ বছর ক্যাম্পে থাকায় এখন তারা এমন আচরণ করছে যে, তারাই প্রকৃত অধিবাসী। তাছাড়া রোহিঙ্গারা তাদের মাদক ব্যবসা বিশেষ করে ইয়াবা ও আইস,মাদক ব্যবসা এবং অস্ত্র ব্যবসায় স্থানীয়দের ব্যবহার করছে। এতে এক সময় উখিয়া ও টেকনাফ সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। স্থানীয়রা জানান, দিন দিন অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা।

মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নিয়ে বিপদে পড়েছে বাংলাদেশ। একদিকে রোহিঙ্গাদের ভরন পোণের বিপুল অর্থ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের মধ্যে দিন দিন বাড়ছে অপরাধ কর্মকান্ড। কক্সবাজার জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত সাত বছরে মোট ৩ হাজার ৮২৩টি মামলায় আসামি করা হয়েছে ৮ হাজার ৬৮৯ জনকে।তার মধ্যে হত্যা মামলা ২৩৩টি, অস্ত্র মামলা ৪০৯টি, মাদক মামলা ২৪৭৯টি, ধর্ষণ মামলা ১০৭, অপহরণ ৫৬, ফরেনার্স ট্যাক্ট ৪২, মানব পাচার মামলা হয়েছে ৩৮টি, ডাকাতি ৬২টি, বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৭৬টি। এছাড়া অন্যান্য মামলা হয়েছে ৩১৪টি। সর্বশেষ চলতি বছরে জুলাই পর্যন্ত ৩২টি হত্যা মামলায় আসামি হয়েছে ২০৪ জন। ১৬০টি মাদক মামলায় আসামি হয়েছে ২৪৩ জন।কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেসব ঘটনা ঘটছে, তার বেশির ভাগই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটছে। বিশেষ করে কথিত আরসা’ এবং ‘আরএসও’ নামে দুটি সংগঠনের মাঝে এ সংঘাত হচ্ছে। তবে অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার কাজ চলমান বলে জানান তিনি। আতঙ্কে স্থানীয়রা :দিন যত যাচ্ছে, বেপরোয়া মনোভাব ও অপরাধ কর্মকাণ্ড ততই বাড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা। এতে স্থানীয় বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে রয়েছেন।

বিশেষ করে উখিয়া এবং টেকনাফে দিন দিন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে সবার মাঝে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন বলে দাবি তাদের। সর্বশেষ চলতি বছরের ২১ আগস্ট টেকনাফে নয়াপাড়া মোছনী রেজিস্টার্ড ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন স্থানীয়দের বাড়িতে ডাকাতির পর দুদু মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ তারেক (২২) ও মোহাম্মদ রাসেল (২০) নামে দুই জনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় রোহিঙ্গা ডাকাত দল। পরে ৫ লাখ টাকার মুক্তিপণে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনা জানাজানি হলে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মাঝে সংঘর্ষ শুরু হয়। উত্তেজিত জনতা কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক অবরোধ করে। এ সময় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা এপিবিএন সদস্যরা কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে উভয় পক্ষকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ইটের আঘাতে মোছনী গ্রামের শাহরিয়ার নাফিস জয় ও লোকমান হাকিমসহ বেশ কয়েক জন আহত হয়। সু-শাসনের জন্য নাগরিক(সুজন)উখিয়ার সভাপতি নুর মোহাম্মদ শিকদার বলেন,আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একজনও ৭ বছরের ভিতর ফেরত পাঠাতে পারেনি।রোহিঙ্গাদের মনোভাব দিন-দিন আগ্রাসীতে পরিণত হচ্ছে।দ্রুত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ায় কবে নাগাদ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে পারবে তা নিয়েও শংকিত আমরা। উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে আমরাই এখন আতঙ্কে থাকি।

রোহিঙ্গা আসার পর এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা চুরি, ডাকাতি, খুন, অপহরণ, মাদকসহ নানা ধরনের অপরাধে যুক্ত। এলাকার অনেক মানুষকে তারা অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছি।রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার হেলাল উদ্দিন বলেন, মিয়ানমারে সহিংসতা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন স্থানে কাজ করছে। আর অপরাধীরা মানব পাচার, মাদক চোরাচালানসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মিয়ানমারের দুটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে প্রায় সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। মাঝে মাঝে তারা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে।স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, রাখাইন রাজ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দুই দেশের একাধিক চোরাচাল সিন্ডিকেট ইয়াবা ও আইসের বড় চালান নিয়ে আসছে। মাদকের টাকায় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কিনছে ভারি অস্ত্র ও গোলাবারুদ। আদিপত্য বিস্তারের জন্য তাদের মধ্যে প্রায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।

পরিস্থিতিতে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো বিকল্প দেখছে না সমাজচিন্তকরা। তারা মনে করছেন রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের ফেরত পাঠাতে যতই দেরি হবে ততই বাংলাদেশকে সংকটে পড়তে হবে। স্বল্প উন্নত দেশের কাতারে থেকে বের হয়ে নিম্ন।মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে রোহিঙ্গারা বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ দাতা গোষ্ঠীর অনুদান কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের খাওয়া দাওয়া, স্বাস্থ্য চিকিৎসা ও বাসস্থান অর্থাৎ পরিসেবার জন্য বাংলাদেশকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। এটা জিডিপির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।বিশেষজ্ঞদের মতামত হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর বিকল্প নেই।

এই সংকট সমাধানে ইউএনএইচসিআ’কে ভারত ও চীনকে আরো বেশি সম্পৃক্ততায় রেখে সংকট সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। এজন্য আরো অত্যধিক সক্রিয় হতে হবে বাংলাদেশকে,এমনটাই মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা।এদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়ায় স্থানীয়দের মাঝে দিন-দিন হতাশার মাত্রা বাড়ছে।স্থানীয়রা সংখ্যায় কম,আর রোহিঙ্গারা সংখায় বেশী এবং আগ্রাসী।চুরি-ছিনতাই,ডাকাতি,খুন,রাহাজানি, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সংঘঠন,ইয়াবা,আইস,মাদক ও চোরাচালান সহ নানা অপরাধে সম্পৃক্ত রোহিঙ্গাদের আচরণেও অতিষ্ঠরা স্থানীয় জনগোষ্ঠী। কবে নাগাদ রোহিঙ্গারা তাদের দেশে ফেরত যাবে,ভুমি,বাগান,জমি খালী হবে ভাবিয়ে তুলছেন।কবে নিজভুম থেকে পরবাসীর কলংক মুছে যাবে?তা দেখার অপেক্ষায় স্থানীয় জনগোষ্ঠী।

ট্যাগ :
পাঠকপ্রিয়

চকরিয়ায় বসতভিটা ও দোকান দখলের জন্য হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট: আহত ৫

রোহিঙ্গা সংকটের ৭ বর্ষ পার: বাড়ছে রোহিঙ্গা: বাড়ছে অপরাধ: স্থানীয়দের উপর নিদারুণ প্রভাব

প্রকাশিত সময় : ১২:৫৭:৪১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৪

মিয়ানমারের বলপুর্বক বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের এপারে আগমনের সাত বছর পেরিয়ে অষ্টম বর্ষে পা রেখেছে।মানবিক বিবেচনায় আশ্রয় দেওয়া রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরাতে নানা কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্যেও আলোর মুখ দেখেনি প্রত্যাবাসন। ফলে রোহিঙ্গা সংকট দিন-দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। ক্যাম্পের এসব শরণার্থীদের তিন বেলা খাবারও জুটছে না।পুষ্টিহীনতায় ভুগছে শিশুরা। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে গড়ে আরোও নব্বইজন করে শিশু। যার ফলে গত ৭ বছরে ক্যাম্পে নতুন করে প্রায় দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বেড়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক অর্থ সহায়তা বাড়েনি,বরং কমছে।অনুদান কমে যাওয়ায় উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের মাসিক খাদ্য ভাউচার ৩ মাসের মধ্যে ২বার কমাতে হয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের দৈনিক রেশন ৩৩ শতাংশ কমে গেছে। শুরুতেই প্রতিমাসে তাদের দেয়া হতো জনপ্রতি ১২ ডলারের খাদ্য সহায়তা। এরপর এটা কমিয়ে করা হয়েছে ১০ ডলার। আর এখন দেয়া হচ্ছে ৮ ডলারের খাবার। রেশন কমিয়ে দেয়ায় রোহিঙ্গাদের মধ্য হতাশা ও ক্ষোভ বেড়েছে। ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা বলছেন তাদের ৮ ডলার।বা বাংলাদেশি ৯০০ টাকার খাবার দেয়া হচ্ছে।

যা দিয়ে ৩ বেলা তো দূরে থাক, একবেলাও তারা পেট ভরে খেতে পারছেন না। ভালো খাবারতো তাদের ভাগ্যেই জুটে না।পেটের দায়ে অনেক রোহিঙ্গা কাজের সন্ধানে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় ভাবে টেকনাফ বন্দরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা পরিচয় গোপন রেখে স্বল্প মজুরিতে দিনমজুরের কাজ করছে।এতে স্থানীয় জনগনের উপর ঋণাত্মক প্রভাব তৈরি করছে।যা,স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা শুধু নয়,নেতিবাচক প্রচাব ফেলেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারি গোয়েন লুইস সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন যে,বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের খাদ্য সাহায্য কমাতে বাধ্য হচ্ছে। এতে তাদের স্বাস্থ্য, পুষ্টির ফলাফল হবে ভয়াবহ।নারী, শিশু ও সবচেয়ে নাজুক মানুষগুলো বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এমনি পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের জন্য জরুরি অর্থায়নের আহবান জানিয়েছেন জাতিসংঘের দাতাদেশ ও সংস্থা গুলো সাহায্য সংগ্রহে তৎপরতা অব্যাহত রাখলেও আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছে না। তাই বাংলাদেশকে বাধ্য হয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে ৭০ কোটি ডলার ঋণ ও অনুদান নিতে হচ্ছে।

এর মধ্যে ৫৪ কোটি ডলার ঋণ এবং ১৬ কোটি ডলার অনুদান।বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ এবং আর্থিক সহায়তা কমানোতে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হচ্ছে।গত এক বছরে সরকারের খরচ হয়েছে ১৭০কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৭ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। এতথ্য ত্রান ও পূর্ণবাসন মন্ত্রনালয়ের। বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ যত খরচ করছে তার ৫০ শতাংশেরও জোগান দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হিমশিম খাচ্ছে।

তিন হাজার ডলারেরও কম মাথাপিছু আয়ের একটি দেশ বছরে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করছে নিজের পকেট থেকে। এক্ষেত্রে দাতাগোষ্ঠীকে আরো এগিয়ে আসা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন।বিগত ২০১৭ সালে নতুন করে প্রায় ১০ লাখের বেশী রোহিঙ্গারা আগমন ঘটে।পুর্বের আশ্রিত সহ সব মিলিয়ে ১২ লাখের বেশী রোহিঙ্গার বসবাস এদেশে।আবার নতুন করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন ৯০টি শিশু জন্ম নিচ্ছে। গত ৭ বছরের জন্ম নিয়েছে প্রায় ২ লাখের বেশী শিশু। যদিও নিবন্ধন হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার শিশুর। ফলে ক্যাম্পে দিন দিন বাড়ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, বাড়ছে তাদের চাহিদাও। রোহিঙ্গাদের উর্ধ্বমুখী জন্মহার বাংলাদেশের জন্য যেমন মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যাম্পে যত শিশু বাড়ছে, ততই রোহিঙ্গা শিশুদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এদের বড় হতে হচ্ছে ক্যাম্পের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও চরম পুষ্টিহীনতার মধ্যে। ক্যাম্পে তাদের জন্য বিভিন্ন এনজিও উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করলেও সেটি হচ্ছে সীমিত পরিসরে।

রোহিঙ্গা ভাষায় পর্যাপ্ত বই নেই। এখানকার স্কুলে বাংলা ভাষায় না পড়াতে বারণ রয়েছে।এতে কাউকে পড়ানোর হয় না। রোহিঙ্গা ভাষা ও ইংরেজী ভাষায় তাঁদের পাঠদান করা হয়। ডেনিশ রিফিউজিম কাউন্সিল নামে একটি এনজিওতে কাজ করেন আবু তাহের। তিনি সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে জানান, এখানকার শিশুরা খুবই অবহেলিত। তারা ভালো খাবার পায় না। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ না থাকায় তারা সর্দি কাশি, জ্বর, ডায়রিয়া ও নিমোনিয়া জনিত রোগ-শোকে ভোগে থাকেন।পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সুত্র জানায়, রোহিঙ্গারা জন্ম নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে মোটেও পরিচিত নন।তাই এব্যাপারে মোটেই আগ্রহী নয় তারা। তাদের সচেতন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ মনে করে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পাপ,এমন নেতিবাচক ধারণা কু-সংস্কারের জন্ম দিচ্ছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে সচেতন করতে ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৩৫টি এনজিও’র সাড়ে তিন হাজার কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মী কাজ করছেন। ইসলামের আলোকে জন্ম নিয়ন্ত্রণে সচেতন করতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন স্থানীয় মসজিদগুলোর মাধ্যমে কাজ চালাচ্ছে।এরফলে এখন অনেকেই জন্মনিয়ন্ত্রণে আগ্রহী হচ্ছেন। এই কর্মসূচি কার্যকর করতে হলে বিনাখরচে তাদের কনডম ও পিল দিতে হবে।

কারণ যেখানে ঠিকমতো তিন বেলা ভাত জুটছে না, সেখানে রোহিঙ্গারা টাকা খরচ করে এসব কিনতে আগ্রহী নন।বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতিসংঘের মাধ্যমে প্রত্যেক সাবালকদের ২টির বেশি সন্তান নেয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করলে জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম অত্যধিক কার্যকর হতো। এরই মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাতিসংঘকে কে পরিবার পরিকল্পনায় জোর দেয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়।শরণার্থী বিষয়ক এক সভায় বাংলাদেশের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে জন্মনিয়ন্ত্রনে জোর দেয়ার আহবান জানিয়েছিলেন।

তিনি ওই সময় দাবি করছিলেন যে, আশ্রয় গেঁড়ে প্রতি বছর ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিচ্ছে। এতে প্রায় ৭ বছর কাছাকাছি সময়ে বছরের নিবন্ধন মতে দেড় লাখের বেশী শিশু অটোমোটিক বেড়ে গেছে। এ সংখ্যা আরো বেশী ছাড়িয়ে যাবে। এটাকে বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন,এটা ট্যাকেল দেযার জন্য সব ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে।ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফ ও সেভ দ্যা চিলড্রেনের পরিসংখ্যান জানায়,বর্তমানে প্রতিদিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যুক্ত হচ্ছে প্রায় ৯০ জন শিশু। ফলে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ। এতে স্থানীয় জনগণের মধ্যে চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। কারণ যেভাবে রোহিঙ্গার সংখ্যা বাড়ছে এভাবে বাড়তে থাকলে শুধু টেফনাফ ও উখিয়া নয়, পুরো কক্সবাজার জেলা জুড়ে স্থানীয় অধিবাসীরা সংখ্যা লঘু হয়ে পড়বে।

এমন আশংকা উড়ে দেওয়া যায় না। তাছাড়া বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে উখিয়ায় ও টেকনাফে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ চাহিদার তুলনায় সেখানে সব্জী, মাছ, মাংসসহ নিত্যপণ্যের সরবরাহ কম। তাই এখানে নিত্যপণ্য বিশেষ করে শাক সবজি, মাছ মাংসের দাম আকাশ ছোঁয়া। স্থানীয়রা মনে করছেন বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কারণে তাদের নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে এ বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। আগে এই দুই উপজেলায় যে পরিমাণ শাক সবজি ও মাছ উৎপাদন হতো, তাতে স্থানীদের চাহিদা পূরণ হয়ে আরো উদ্বৃদ্ধ থাকতো। যেগুলো কৃষকরা বাইরে বিক্রি করতেন।

রোহিঙ্গাদের জায়গা দিতে গিয়ে এখন জমি কমে যাওয়ায় উৎপাদনতো কমেছেই, চাহিদা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ বেশি। ফলে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে স্থানীয়রা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না শুধু চরম ক্রান্তিকাল পার করছেন বললেই চলে।দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে স্থানীয় দরিদ্র লোকজনদের। একই ভাবে শ্রম বাজার আস্তে আস্তে রোহিঙ্গাদের দখলে চলে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে।দেখা দিচ্ছে চরম বিপর্যয়।এ ছাড়াও টেনাফ ও উখিয়ার বাসিন্দরা বাইরে বের হলে বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রামে যাওয়ার সময় তাদের নানা ঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে। তল্লাশীর সময় তাদের প্রমাণ করতে হয় তারা রোহিঙ্গা নন। পাসপোর্ট বানাতে কিংবা বিদেশ যেতে গেলে তাদের নানাভাবে হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে।রোহিঙ্গাদের মধ্যে আর্থিক অবস্থা ভালো, তারা দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশের এনআইডি কার্য ও পাসপোর্ট বানিয়ে নিচ্ছে। আর এ পাসপোর্ট তৈরির জন্য তারা দেশের বিভিন্ন স্থানের ঠিকানা ব্যবহার করছে।রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট ও এআইডি করে দেয়ার অভিযোগে সম্প্রতি ২৩ জনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ।গ্রেফতারকৃত দালালদের মোবাইলে শত শত পাসপোর্ট করে দেয়ার প্রাসঙ্গিক সফট ডকুমেন্টস, ডেলিভারি স্লিপ পাওয়া গেছে। যার মধ্যে গত ৫ মাসে রোহিঙ্গাদের জন্য করা প্রায় দেড়শোটি পাসপোর্ট ইতোমধ্যে তারা সরবরাহ করেছে।উখিয়ায় ও টেকনাফে এখনো তৈরি হচ্ছে রোহিঙ্গা বসতি।নতুন করে বিচ্ছিন্ন ভাবে দালাল চক্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ঢুকছে। এর ফলে কৃষি জমি, পাহাড়, বন ও জীবনবৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

রোহিঙ্গারা যে সব এলাকায় বসবাস করছে, সেসব এলাকা ও আশপাশে টেকনাফ ও উখিয়ার.বহু পরিবার কৃষি কাজ ও মাছ ধরার পেশার নিয়োজিত ছিল। কিন্তু এখন কৃষি জমির বিশাল অংশে রোহিঙ্গাদের বর্জ্য আর্বজনা ফেলছে। ফলে বহু ফসলি জমি ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়ে চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এতে স্থানীয়দের অনেকেই বেকার হয়ে পড়েছেন।টেকনাফ ও উখিযায় এক সময় ছিল সবুজের সমারোহ। প্রচুর গাছপালা ছিল। এখন সেখানে সবুজ নেই,আছে অগণন ছোট খুপরি ঘর। জ্বালানির প্রয়োজনে গাছ কেটে সাবাড় করে ফেলা হচ্ছে।রোহিঙ্গাদের বসতির কারণে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ নিয়ন্ত্রণাধীন উখিয়া ও টেকনাফে ১২ হাজার একর বনভূমি ধ্বংস হয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ২ লাখ ১২ হাজার ৬০৭টি গোসলখানা, ত্রাণ সংরক্ষণের জন্য ২০টি অস্থায়ী গুদাম, ১৩ কিলোমিটার বিদ্যুতের লাইন, ৩০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ এবং ২০ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। এতে ২ হাজার ২৩১ কোটি টাকার বন ধ্বংস হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে সেখানকার পরিবেশ, বন ও জীব বৈচিত্র্য। এ ছাড়াও এক সময় এ অঞ্চল দিয়ে এশিয়ান হাতির আবাস্থল ও বিচরণক্ষেত্র ছিল।

এখন আর সেখানে হাতি খুব একটা দেখা যায় না। এক সময় এই উখিয়া ও টেকনাফ ছিল শান্তির জনপদ। এখানে প্রচুর ফসল হতো। শাক-সবজি, ধান হতো, সুপারি হতো, হতো প্রচুর কাঠ। মানুষ বেশ সুখের ছিল। সাড়ে ১৪ লাখ রোহিঙ্গাকে জায়গা দিতে গিয়ে উখিয়া ও টেকনাফের বাসিন্দাদের শান্তি কেড়ে নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সুত্র মতে, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে ৩২টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয়। এসব গ্রুপের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড দিন দিন বেড়েই চলছে। একই সঙ্গে ইয়াবা ও আইস,মাদক ও চোরাই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপে দেখা যায় উখিয়ায় মোট জনসংখ্যা ২ লাখ ৬৩ হাজার ১৮৬ জন এবং টেকনাফে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮৬৩ জন। অর্থাৎ দুই উপজেলা স্থানীয় জনসংখ্যা হচ্ছে ৫ লাখ ৫৭ হাজার ৪৯ জন। আর এই দুই উপজেলায় রোহিঙ্গা রয়েছেন সাড়ে ১৪ লাখ। যা,দুই থানায় স্থানীয় জনগণের চেয়ে প্রায় আড়াইগুণ বেশি। ফলে এখানে স্থানীয়রা সংখ্যালগুতে পরিণত হয়েছে।

এদিকে কক্সবাজার জেলায় ৯টি উপজেলায় মোট জনসংখ্যা ২৮ লাখ ৯৩ হাজার ২৬৫ জন। আর কক্সবাজারে রোহিঙ্গা রয়েছে সাড়ে ১৪ লাখ। যেভাবে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বাড়ছে এক সময় কক্সবাজার জেলায় স্থানীয়রা সংখ্যা লঘুতে পরিণত হতে পারে বলে আশংকা করছেন অনেকেই।এদিকে উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দারা রোহিঙ্গাদের কারণে নিজেদের অস্তিত্ব ও ভবিষ্যতে নিয়ে উদ্বিগ্ন। একটানা ৭ বছর ক্যাম্পে থাকায় এখন তারা এমন আচরণ করছে যে, তারাই প্রকৃত অধিবাসী। তাছাড়া রোহিঙ্গারা তাদের মাদক ব্যবসা বিশেষ করে ইয়াবা ও আইস,মাদক ব্যবসা এবং অস্ত্র ব্যবসায় স্থানীয়দের ব্যবহার করছে। এতে এক সময় উখিয়া ও টেকনাফ সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। স্থানীয়রা জানান, দিন দিন অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা।

মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নিয়ে বিপদে পড়েছে বাংলাদেশ। একদিকে রোহিঙ্গাদের ভরন পোণের বিপুল অর্থ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের মধ্যে দিন দিন বাড়ছে অপরাধ কর্মকান্ড। কক্সবাজার জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত সাত বছরে মোট ৩ হাজার ৮২৩টি মামলায় আসামি করা হয়েছে ৮ হাজার ৬৮৯ জনকে।তার মধ্যে হত্যা মামলা ২৩৩টি, অস্ত্র মামলা ৪০৯টি, মাদক মামলা ২৪৭৯টি, ধর্ষণ মামলা ১০৭, অপহরণ ৫৬, ফরেনার্স ট্যাক্ট ৪২, মানব পাচার মামলা হয়েছে ৩৮টি, ডাকাতি ৬২টি, বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৭৬টি। এছাড়া অন্যান্য মামলা হয়েছে ৩১৪টি। সর্বশেষ চলতি বছরে জুলাই পর্যন্ত ৩২টি হত্যা মামলায় আসামি হয়েছে ২০৪ জন। ১৬০টি মাদক মামলায় আসামি হয়েছে ২৪৩ জন।কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেসব ঘটনা ঘটছে, তার বেশির ভাগই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটছে। বিশেষ করে কথিত আরসা’ এবং ‘আরএসও’ নামে দুটি সংগঠনের মাঝে এ সংঘাত হচ্ছে। তবে অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার কাজ চলমান বলে জানান তিনি। আতঙ্কে স্থানীয়রা :দিন যত যাচ্ছে, বেপরোয়া মনোভাব ও অপরাধ কর্মকাণ্ড ততই বাড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা। এতে স্থানীয় বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে রয়েছেন।

বিশেষ করে উখিয়া এবং টেকনাফে দিন দিন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে সবার মাঝে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন বলে দাবি তাদের। সর্বশেষ চলতি বছরের ২১ আগস্ট টেকনাফে নয়াপাড়া মোছনী রেজিস্টার্ড ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন স্থানীয়দের বাড়িতে ডাকাতির পর দুদু মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ তারেক (২২) ও মোহাম্মদ রাসেল (২০) নামে দুই জনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় রোহিঙ্গা ডাকাত দল। পরে ৫ লাখ টাকার মুক্তিপণে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনা জানাজানি হলে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মাঝে সংঘর্ষ শুরু হয়। উত্তেজিত জনতা কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক অবরোধ করে। এ সময় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা এপিবিএন সদস্যরা কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে উভয় পক্ষকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ইটের আঘাতে মোছনী গ্রামের শাহরিয়ার নাফিস জয় ও লোকমান হাকিমসহ বেশ কয়েক জন আহত হয়। সু-শাসনের জন্য নাগরিক(সুজন)উখিয়ার সভাপতি নুর মোহাম্মদ শিকদার বলেন,আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একজনও ৭ বছরের ভিতর ফেরত পাঠাতে পারেনি।রোহিঙ্গাদের মনোভাব দিন-দিন আগ্রাসীতে পরিণত হচ্ছে।দ্রুত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ায় কবে নাগাদ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে পারবে তা নিয়েও শংকিত আমরা। উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে আমরাই এখন আতঙ্কে থাকি।

রোহিঙ্গা আসার পর এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা চুরি, ডাকাতি, খুন, অপহরণ, মাদকসহ নানা ধরনের অপরাধে যুক্ত। এলাকার অনেক মানুষকে তারা অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছি।রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার হেলাল উদ্দিন বলেন, মিয়ানমারে সহিংসতা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন স্থানে কাজ করছে। আর অপরাধীরা মানব পাচার, মাদক চোরাচালানসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মিয়ানমারের দুটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে প্রায় সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। মাঝে মাঝে তারা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে।স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, রাখাইন রাজ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দুই দেশের একাধিক চোরাচাল সিন্ডিকেট ইয়াবা ও আইসের বড় চালান নিয়ে আসছে। মাদকের টাকায় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কিনছে ভারি অস্ত্র ও গোলাবারুদ। আদিপত্য বিস্তারের জন্য তাদের মধ্যে প্রায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।

পরিস্থিতিতে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো বিকল্প দেখছে না সমাজচিন্তকরা। তারা মনে করছেন রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের ফেরত পাঠাতে যতই দেরি হবে ততই বাংলাদেশকে সংকটে পড়তে হবে। স্বল্প উন্নত দেশের কাতারে থেকে বের হয়ে নিম্ন।মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে রোহিঙ্গারা বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ দাতা গোষ্ঠীর অনুদান কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের খাওয়া দাওয়া, স্বাস্থ্য চিকিৎসা ও বাসস্থান অর্থাৎ পরিসেবার জন্য বাংলাদেশকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। এটা জিডিপির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।বিশেষজ্ঞদের মতামত হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর বিকল্প নেই।

এই সংকট সমাধানে ইউএনএইচসিআ’কে ভারত ও চীনকে আরো বেশি সম্পৃক্ততায় রেখে সংকট সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। এজন্য আরো অত্যধিক সক্রিয় হতে হবে বাংলাদেশকে,এমনটাই মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা।এদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়ায় স্থানীয়দের মাঝে দিন-দিন হতাশার মাত্রা বাড়ছে।স্থানীয়রা সংখ্যায় কম,আর রোহিঙ্গারা সংখায় বেশী এবং আগ্রাসী।চুরি-ছিনতাই,ডাকাতি,খুন,রাহাজানি, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সংঘঠন,ইয়াবা,আইস,মাদক ও চোরাচালান সহ নানা অপরাধে সম্পৃক্ত রোহিঙ্গাদের আচরণেও অতিষ্ঠরা স্থানীয় জনগোষ্ঠী। কবে নাগাদ রোহিঙ্গারা তাদের দেশে ফেরত যাবে,ভুমি,বাগান,জমি খালী হবে ভাবিয়ে তুলছেন।কবে নিজভুম থেকে পরবাসীর কলংক মুছে যাবে?তা দেখার অপেক্ষায় স্থানীয় জনগোষ্ঠী।