০২:৩১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাস টার্মিনালের ‘মাফিয়া’ মিজানের হাতে মাদক সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ

মাদকের আন্ডারওয়ার্ল্ডে তিনি নতুন যুবরাজ হিসেবে পরিচিত। কেউ কেউ বলেন গডফাদার। বর্তমানে তার হাতেই কক্সবাজার কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের মাদক সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। বাসের হেলপার থেকে মাদক সম্রাট হিসেবে ক্ষমতা রপ্ত করা এই যুবরাজের ভয়ংকর কুৎসিত চেহারা বেরিয়ে আসে অনুসন্ধানে। তার নাম মিজান। তিনি সদরের ঝিলংজার ১ নং ওয়ার্ডের পূর্ব লারপাড়ার দিনমজুর ইয়ার মোহাম্মদ ও রোকেয়া বেগম দম্পত্তির ছেলে। সম্প্রতি মিজানের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমে চোখ আটকে যায়। স্থানীয়রা বলছেন, দিনমজুর বাবার ছেলে মিজানই বাস টার্মিনালসহ কক্সবাজার শহরের ইয়াবা জগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী। তার ইশারার বাইরে কিছুই হয় না। বাস টার্মিনালে মাদক আগ্রাসন বন্ধের জন্য তার ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানান, প্রতি রাতে কক্সবাজারে কর্মরত কতিপয় পুলিশ অফিসারদের সাথে প্রতি রাতে আড্ডায় মেতে উঠেন। তাদের প্রভাব কাটিয়ে সীমান্ত এলাকা থেকে মাদকের বড় বড় চালান এনে বাস টার্মিনাল থেকে বাসযোগে অনেকটা বিনা বাধায় তার মাদকের চালান পাচার করা হয়। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার মাদকের চালান আটক করতে চাইলেও তার নানান কারিশমা, অদৃশ্য অপশক্তি ও নানা প্রভাবে তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। একসময় দুটি অস্ত্রসহ র্যাব তাকে হাতেনাতে আটক করে। পরে মাদক পাচারের দুটি মামলাও হয়।

কিন্তু এতেও তাকে দমানো যায় নি। ফলে প্রশাসনের সাথে পেরে উঠা এই মাদক সম্রাটের সাহস এখন আকাশ চুম্বী। সূত্র জানায়, এই মাদক সম্রাটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বাসটার্মিনাল-লারপাড়ার খুঁচরা মাদক ব্যবসায়ীরা। মিজান ও তার রোহিঙ্গা স্ত্রী নুর হাফিজার নেতৃত্বে নাফ নদী সীমান্তের কেরুনতলী, বরইতলী, জাদিমুরা, শাহপরীরদ্বীপসহ কয়েকটি স্পটে মিয়ানমার থেকে প্রকাশ্যে কক্সবাজারে আসছে মাদকের চালান। শুধু ব্যবসাতেই ক্ষান্ত নয় মিজান। লারপাড়া-বাসটার্মিনালের কয়েকটি স্পটে মিজানের নেতৃত্বে তার অনুসারীরা মাদকের চালান খালাসে চাঁদা আদায় ও সরবরাহ করছে দাপটের সাথে।

এতে চরম উৎকন্ঠা ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে স্থানীয়রা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কক্সবাজার জেলার অনেক কর্মকর্তারা বিষয়টি ওয়াকিবহাল নন। তবে বিভিন্ন দৈনিক মেহেদীতে একাধিক সংবাদ প্রকাশ হলেও মাদক সম্রাট মিজান কিংবা তার বাহিনীর বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় নানা প্রশ্ন দেখা দেয় জনমনে। উল্টো বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তর ও বাসটার্মিনাল এলাকায় কথিপয় পুলিশ কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে প্রকাশ্যে মহড়া, দেন দরবার বেপরোয়া ঘুরাফেরার বিষয়টি আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি ডেকে আনবে বলে অভিমত সচেতন মহলের। অভিযোগ আছে, মিজানের বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় রয়েছে দুটি মাদক মামলা। ২০২১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী বাস টার্মিনাল সংলগ্ন নূর আবাসিক হোটেল থেকে সালাউদ্দিন সুমন (৩৩) নামের এক ব্যক্তিকে ২৯,২৭০ পিস ইয়াবাসহ আটক করেছে র‌্যাব সদস্যরা। আটক সালাউদ্দিন সুমন ফেনী দাগনভূইয়া এলাকার মৃত আনোয়ার হোসেনের ছেলে বলে জানা গেছে। ওই মাদক ব্যবসায়ী মিজানের সহযোগী।

বাস টার্মিনাল সংলগ্ন নূর আবাসিক হোটেলে বসে ইয়াবার চালানটপ পাচারের উদ্দেশ্যে অবস্থান করে। এসময় সঙ্গে থাকলেও সেদিন কৌশলে পালিয়ে যায় মিজান। ওই মামলায় আদালতে মিজানকে অভিযুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনও জমা দিতে পারেনি তদন্ত কর্মকর্তা। অস্ত্র-মাদক মামলাগুতে মিজান চার্জশিটভূক্ত আসামী হওয়ার পরেও বীরদর্পে ঘুরছে তিনি। কথিত পুলিলের জব্দ মাদক ক্রেতা হিসেবে পরিচিতি থাকায় তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। স্থানীয়রা জানান, সম্প্রতি দরিয়ানগর এলাকা থেকে মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্য। যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকায় দেশটিতে চরম জ্বালানি তেল ও খাদ্য সংকটে ভুগছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মাদক আমদানী করতে কক্সবাজার থেকে মিজানের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট দেশটিতে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল ও নিত্যপণ্য পাচারের নকশা এঁকেছে। বিনিময়ে পাচ্ছে সমমূল্যের ইয়াবা কিংবা চলনশীল অন্য কোনো মাদক দ্রব্য।

আর এই ভয়ঙ্কর তেল পাচারকাণ্ডে জড়িত রয়েছে মিজান সিন্ডিকেটের একাধিক জনপ্রতিনিধি, চিহ্নিত মাদক কারবারি এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের শীর্ষ কয়েকজন অসাধু ব্যাক্তি। মিজান কয়েকজন অসৎ পুলিশ অফিসারের মাইম্যান হিসেবে পরিচিত থাকায় জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য জিসিপত্র পাচার কাণ্ড দিনের পর দিন আরও বেড়েই চলছে। সূত্র বলছে, মিজানের বাস চালাক ও তার সোর্স হিসেবে কাজ করেন নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন। মিজান নিজস্ব আস্তায় বসে সংগ্রহ করতেন মাদক পাচারকারীর তথ্য। আর পুলিশের সাথে অভিযানে পাঠাতো তার নিজস্ব পুলিশগুলো। এতে জব্দ করা মাদক সরিয়ে বিক্রি করেন এবং পাওয়া টাকা দুই ভাগ করতেন তারা।  এভাবে তারা দীর্ঘবছর মাদক পাচার কিংবা জব্দ করে আসলেও সম্প্রতি তাদের ব্যবসায়ীক বন্ধনটি ভেঙ্গে যায়। কারণ হিসেবে জানা যায়, গেল বছরের মার্চ মাসের দিকে একটি মাদকের চালান জব্দ করতে পুলিশের সাথে অভিযানে পাঠায় মিজানের কয়েকজন সহযোগীকে। এতে ১ লাখ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। পরে সেখানে অংশ নেন মিজান। জব্দ করা ১ লাখ পিস ইয়াবা থেকে মিজান ২০ হাজার ইয়াবা অন্যত্র নিয়ে যায়। পরে ৮০ হাজার ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে বলে প্রচার করে।

এই ঘটনায় তাদের মধ্যে অভন্তরীণ দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর জের ধরে মিজান তার নিজস্ব সন্ত্রাসী দিয়ে ওই দুজনকে তুলে নিয়ে তার আস্তায় নিয়ে যায়। সেখানে তাদের উপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। নির্যাতনের এক পর্যায়ে তাদেরকে ৪ পিস ইয়াবাসহ আটক দেখিয়ে তাদের কারাগারে পাঠান মিজান। কারাভোগের পর বর্তমানে তারা জামিনে রয়েছে। এদিকে এক অনুসন্ধানে জানা যায়- কক্সবাজার থেকে বাসযোগে সারাদেশে ইয়াবা পাচারে জড়িত সিন্ডিকেটটি স্থানীয় মিজানের নেতৃত্বে চলছে বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। তার সিন্ডিকেটের সাথে আরও কাজ করছে- পুলিশের কথিপয় সদস্য।

এদের মধ্যে মিজানের নেতৃত্বে রয়েছে ২টি সিএনজি। এসব সিএনজি দিয়ে ইয়াবা জেলার মধ্যে পাচার করা হয়। আর বিকাশের একটি দোকান রয়েছে মিজানের। ওই বিকাশের দোকানের মাধ্যমে মাদক ও অস্ত্রের টাকা আদান-প্রদান করে মিজান। মিজানের এই সিন্ডিকেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন পুলিশের কথিপয় সদস্যরা। তবে সরকার পরিবর্তনের পর তারা এখন অনেকটা নিষ্ক্রিয় রয়েছে। তারা আগে পাচারের জন্য প্রস্তুতকৃত মাদক অন্যান্য জিনিসপত্র পাচারের পূর্ব মুহুর্তে পর্যন্ত পাহারা দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। প্রবেশ বা চলাচলের পথে মিজানের নেতৃত্বে একটি দল উৎ পেতে বসে থাকেন। অন্যান্য প্রশাসনের লোকজনের উপস্থিতি টের পেলে সিন্ডিকেটের অপরাপর সদস্যদের সতর্ক করে দেন মিজান।

এছাড়াও মিজানের বাড়িতে অস্ত্র-মাদক মজুদ করে রেখে সুযোগ বুঝে পাচার করে বলে জানা যায়। এবিষয়ে স্থানীয় আরিফ, বাস ড্রাইভার ফজল, নজরুলসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, এক সময় মিজান ও তার পরিবার দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করতেন। কিন্তু হঠাৎ করেই তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থান বদলে গেছে। তাদের পরিবার ইয়াবা ও অস্ত্র কারবার করেই টাকার পাহাড় গড়েছেন। এদের বিরুদ্ধে ইয়াবা মামলাও রয়েছে। মিজান কিংবা তাঁর পরিবারের দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা বাণিজ্য নেই। তবে বর্তমানে তাদের রয়েছে বহুতল ভবন, গাড়ির কাউন্টার ও গাড়িসহ সহ আরো অনেক সম্পদ। স্থানীয়রা বলেন, ইয়াবা অস্ত্রসহ র্যাব-পুলিশের হাতে আটক হওয়া মিজান একটি ইয়াবা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন। তার গ্রুপে স্ত্রী রোহিঙ্গা হাফিজাসহ আরো অনেকে রয়েছে। পুলিশের হাতে আটকের পর থেকে কথিত দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যদের সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠে। তাদের জব্দকৃত মাদকের ক্রেতা হিসেবে মিজান বর্তমানে কাজ করছেন।

তার স্ত্রী নুর হাফিজার মাধ্যমে সেই মাদক সারা দেশে পাচার করছেন মিজান। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক সময়ের রিক্তহস্ত মিজান বাস টার্মিনাল এলাকায় বিডিআর ক্যাম্পের সেলিম গংদের কাছ থেকে ১ কোটি ৫ লাখ টাকায় ক্রয় করেছেন সাড়ে ৩ গন্ডা জমি। সেটি বর্তমানে শ্যামলী কাউন্টার হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন। পাশের জমিতে বর্তমানে চলছে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ। পূর্ব লারপাড়া এলাকায় দুই স্ত্রীর জন্য নির্মাণ করেছেন দুটি আলাদা ভবন। বর্তমানে তারা আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করছেন। বাবার বসত ভিটায় নির্মাণ করেছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। এছাড়াও মিজানের রয়েছে ১ টি কার, একাধিক সিএনজি ও দামি বাইক রয়েছে। এই গাড়িগুলো মূলত মাদক পাচারের কাজে ব্যবহৃত হয় বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এইসব অভিযোগ অস্বীকার করে অভিযুক্ত মিজান বলেন, আমি যে সম্পদ গড়েছি তা বাবা জমি বিক্রি করে করেছি। বাকী টাকা আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন দিয়েছে। আপনার বাবাতো দিনজমুর ছিলেন বিক্রি করার জন্য জায়গা জমি কোথায় পেলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তেমন কোন সদোত্তর দিতে পারেনি। এখন যে হোটেল করেছি সেখানে একজন পুলিশ কর্মকর্তাও অংশীদার রয়েছে মিজান দাবি করেন।

ট্যাগ :
পাঠকপ্রিয়

‘স্টেপ ডাউন ইউনুস’পোস্ট করে আটক হলেন যুবক!

বাস টার্মিনালের ‘মাফিয়া’ মিজানের হাতে মাদক সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ

প্রকাশিত সময় : ০১:০৪:৩৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৪

মাদকের আন্ডারওয়ার্ল্ডে তিনি নতুন যুবরাজ হিসেবে পরিচিত। কেউ কেউ বলেন গডফাদার। বর্তমানে তার হাতেই কক্সবাজার কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের মাদক সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। বাসের হেলপার থেকে মাদক সম্রাট হিসেবে ক্ষমতা রপ্ত করা এই যুবরাজের ভয়ংকর কুৎসিত চেহারা বেরিয়ে আসে অনুসন্ধানে। তার নাম মিজান। তিনি সদরের ঝিলংজার ১ নং ওয়ার্ডের পূর্ব লারপাড়ার দিনমজুর ইয়ার মোহাম্মদ ও রোকেয়া বেগম দম্পত্তির ছেলে। সম্প্রতি মিজানের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমে চোখ আটকে যায়। স্থানীয়রা বলছেন, দিনমজুর বাবার ছেলে মিজানই বাস টার্মিনালসহ কক্সবাজার শহরের ইয়াবা জগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী। তার ইশারার বাইরে কিছুই হয় না। বাস টার্মিনালে মাদক আগ্রাসন বন্ধের জন্য তার ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানান, প্রতি রাতে কক্সবাজারে কর্মরত কতিপয় পুলিশ অফিসারদের সাথে প্রতি রাতে আড্ডায় মেতে উঠেন। তাদের প্রভাব কাটিয়ে সীমান্ত এলাকা থেকে মাদকের বড় বড় চালান এনে বাস টার্মিনাল থেকে বাসযোগে অনেকটা বিনা বাধায় তার মাদকের চালান পাচার করা হয়। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার মাদকের চালান আটক করতে চাইলেও তার নানান কারিশমা, অদৃশ্য অপশক্তি ও নানা প্রভাবে তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। একসময় দুটি অস্ত্রসহ র্যাব তাকে হাতেনাতে আটক করে। পরে মাদক পাচারের দুটি মামলাও হয়।

কিন্তু এতেও তাকে দমানো যায় নি। ফলে প্রশাসনের সাথে পেরে উঠা এই মাদক সম্রাটের সাহস এখন আকাশ চুম্বী। সূত্র জানায়, এই মাদক সম্রাটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বাসটার্মিনাল-লারপাড়ার খুঁচরা মাদক ব্যবসায়ীরা। মিজান ও তার রোহিঙ্গা স্ত্রী নুর হাফিজার নেতৃত্বে নাফ নদী সীমান্তের কেরুনতলী, বরইতলী, জাদিমুরা, শাহপরীরদ্বীপসহ কয়েকটি স্পটে মিয়ানমার থেকে প্রকাশ্যে কক্সবাজারে আসছে মাদকের চালান। শুধু ব্যবসাতেই ক্ষান্ত নয় মিজান। লারপাড়া-বাসটার্মিনালের কয়েকটি স্পটে মিজানের নেতৃত্বে তার অনুসারীরা মাদকের চালান খালাসে চাঁদা আদায় ও সরবরাহ করছে দাপটের সাথে।

এতে চরম উৎকন্ঠা ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে স্থানীয়রা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কক্সবাজার জেলার অনেক কর্মকর্তারা বিষয়টি ওয়াকিবহাল নন। তবে বিভিন্ন দৈনিক মেহেদীতে একাধিক সংবাদ প্রকাশ হলেও মাদক সম্রাট মিজান কিংবা তার বাহিনীর বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় নানা প্রশ্ন দেখা দেয় জনমনে। উল্টো বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তর ও বাসটার্মিনাল এলাকায় কথিপয় পুলিশ কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে প্রকাশ্যে মহড়া, দেন দরবার বেপরোয়া ঘুরাফেরার বিষয়টি আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি ডেকে আনবে বলে অভিমত সচেতন মহলের। অভিযোগ আছে, মিজানের বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় রয়েছে দুটি মাদক মামলা। ২০২১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী বাস টার্মিনাল সংলগ্ন নূর আবাসিক হোটেল থেকে সালাউদ্দিন সুমন (৩৩) নামের এক ব্যক্তিকে ২৯,২৭০ পিস ইয়াবাসহ আটক করেছে র‌্যাব সদস্যরা। আটক সালাউদ্দিন সুমন ফেনী দাগনভূইয়া এলাকার মৃত আনোয়ার হোসেনের ছেলে বলে জানা গেছে। ওই মাদক ব্যবসায়ী মিজানের সহযোগী।

বাস টার্মিনাল সংলগ্ন নূর আবাসিক হোটেলে বসে ইয়াবার চালানটপ পাচারের উদ্দেশ্যে অবস্থান করে। এসময় সঙ্গে থাকলেও সেদিন কৌশলে পালিয়ে যায় মিজান। ওই মামলায় আদালতে মিজানকে অভিযুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনও জমা দিতে পারেনি তদন্ত কর্মকর্তা। অস্ত্র-মাদক মামলাগুতে মিজান চার্জশিটভূক্ত আসামী হওয়ার পরেও বীরদর্পে ঘুরছে তিনি। কথিত পুলিলের জব্দ মাদক ক্রেতা হিসেবে পরিচিতি থাকায় তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। স্থানীয়রা জানান, সম্প্রতি দরিয়ানগর এলাকা থেকে মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্য। যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকায় দেশটিতে চরম জ্বালানি তেল ও খাদ্য সংকটে ভুগছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মাদক আমদানী করতে কক্সবাজার থেকে মিজানের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট দেশটিতে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল ও নিত্যপণ্য পাচারের নকশা এঁকেছে। বিনিময়ে পাচ্ছে সমমূল্যের ইয়াবা কিংবা চলনশীল অন্য কোনো মাদক দ্রব্য।

আর এই ভয়ঙ্কর তেল পাচারকাণ্ডে জড়িত রয়েছে মিজান সিন্ডিকেটের একাধিক জনপ্রতিনিধি, চিহ্নিত মাদক কারবারি এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের শীর্ষ কয়েকজন অসাধু ব্যাক্তি। মিজান কয়েকজন অসৎ পুলিশ অফিসারের মাইম্যান হিসেবে পরিচিত থাকায় জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য জিসিপত্র পাচার কাণ্ড দিনের পর দিন আরও বেড়েই চলছে। সূত্র বলছে, মিজানের বাস চালাক ও তার সোর্স হিসেবে কাজ করেন নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন। মিজান নিজস্ব আস্তায় বসে সংগ্রহ করতেন মাদক পাচারকারীর তথ্য। আর পুলিশের সাথে অভিযানে পাঠাতো তার নিজস্ব পুলিশগুলো। এতে জব্দ করা মাদক সরিয়ে বিক্রি করেন এবং পাওয়া টাকা দুই ভাগ করতেন তারা।  এভাবে তারা দীর্ঘবছর মাদক পাচার কিংবা জব্দ করে আসলেও সম্প্রতি তাদের ব্যবসায়ীক বন্ধনটি ভেঙ্গে যায়। কারণ হিসেবে জানা যায়, গেল বছরের মার্চ মাসের দিকে একটি মাদকের চালান জব্দ করতে পুলিশের সাথে অভিযানে পাঠায় মিজানের কয়েকজন সহযোগীকে। এতে ১ লাখ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। পরে সেখানে অংশ নেন মিজান। জব্দ করা ১ লাখ পিস ইয়াবা থেকে মিজান ২০ হাজার ইয়াবা অন্যত্র নিয়ে যায়। পরে ৮০ হাজার ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে বলে প্রচার করে।

এই ঘটনায় তাদের মধ্যে অভন্তরীণ দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর জের ধরে মিজান তার নিজস্ব সন্ত্রাসী দিয়ে ওই দুজনকে তুলে নিয়ে তার আস্তায় নিয়ে যায়। সেখানে তাদের উপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। নির্যাতনের এক পর্যায়ে তাদেরকে ৪ পিস ইয়াবাসহ আটক দেখিয়ে তাদের কারাগারে পাঠান মিজান। কারাভোগের পর বর্তমানে তারা জামিনে রয়েছে। এদিকে এক অনুসন্ধানে জানা যায়- কক্সবাজার থেকে বাসযোগে সারাদেশে ইয়াবা পাচারে জড়িত সিন্ডিকেটটি স্থানীয় মিজানের নেতৃত্বে চলছে বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। তার সিন্ডিকেটের সাথে আরও কাজ করছে- পুলিশের কথিপয় সদস্য।

এদের মধ্যে মিজানের নেতৃত্বে রয়েছে ২টি সিএনজি। এসব সিএনজি দিয়ে ইয়াবা জেলার মধ্যে পাচার করা হয়। আর বিকাশের একটি দোকান রয়েছে মিজানের। ওই বিকাশের দোকানের মাধ্যমে মাদক ও অস্ত্রের টাকা আদান-প্রদান করে মিজান। মিজানের এই সিন্ডিকেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন পুলিশের কথিপয় সদস্যরা। তবে সরকার পরিবর্তনের পর তারা এখন অনেকটা নিষ্ক্রিয় রয়েছে। তারা আগে পাচারের জন্য প্রস্তুতকৃত মাদক অন্যান্য জিনিসপত্র পাচারের পূর্ব মুহুর্তে পর্যন্ত পাহারা দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। প্রবেশ বা চলাচলের পথে মিজানের নেতৃত্বে একটি দল উৎ পেতে বসে থাকেন। অন্যান্য প্রশাসনের লোকজনের উপস্থিতি টের পেলে সিন্ডিকেটের অপরাপর সদস্যদের সতর্ক করে দেন মিজান।

এছাড়াও মিজানের বাড়িতে অস্ত্র-মাদক মজুদ করে রেখে সুযোগ বুঝে পাচার করে বলে জানা যায়। এবিষয়ে স্থানীয় আরিফ, বাস ড্রাইভার ফজল, নজরুলসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, এক সময় মিজান ও তার পরিবার দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করতেন। কিন্তু হঠাৎ করেই তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থান বদলে গেছে। তাদের পরিবার ইয়াবা ও অস্ত্র কারবার করেই টাকার পাহাড় গড়েছেন। এদের বিরুদ্ধে ইয়াবা মামলাও রয়েছে। মিজান কিংবা তাঁর পরিবারের দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা বাণিজ্য নেই। তবে বর্তমানে তাদের রয়েছে বহুতল ভবন, গাড়ির কাউন্টার ও গাড়িসহ সহ আরো অনেক সম্পদ। স্থানীয়রা বলেন, ইয়াবা অস্ত্রসহ র্যাব-পুলিশের হাতে আটক হওয়া মিজান একটি ইয়াবা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন। তার গ্রুপে স্ত্রী রোহিঙ্গা হাফিজাসহ আরো অনেকে রয়েছে। পুলিশের হাতে আটকের পর থেকে কথিত দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যদের সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠে। তাদের জব্দকৃত মাদকের ক্রেতা হিসেবে মিজান বর্তমানে কাজ করছেন।

তার স্ত্রী নুর হাফিজার মাধ্যমে সেই মাদক সারা দেশে পাচার করছেন মিজান। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক সময়ের রিক্তহস্ত মিজান বাস টার্মিনাল এলাকায় বিডিআর ক্যাম্পের সেলিম গংদের কাছ থেকে ১ কোটি ৫ লাখ টাকায় ক্রয় করেছেন সাড়ে ৩ গন্ডা জমি। সেটি বর্তমানে শ্যামলী কাউন্টার হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন। পাশের জমিতে বর্তমানে চলছে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ। পূর্ব লারপাড়া এলাকায় দুই স্ত্রীর জন্য নির্মাণ করেছেন দুটি আলাদা ভবন। বর্তমানে তারা আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করছেন। বাবার বসত ভিটায় নির্মাণ করেছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। এছাড়াও মিজানের রয়েছে ১ টি কার, একাধিক সিএনজি ও দামি বাইক রয়েছে। এই গাড়িগুলো মূলত মাদক পাচারের কাজে ব্যবহৃত হয় বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এইসব অভিযোগ অস্বীকার করে অভিযুক্ত মিজান বলেন, আমি যে সম্পদ গড়েছি তা বাবা জমি বিক্রি করে করেছি। বাকী টাকা আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন দিয়েছে। আপনার বাবাতো দিনজমুর ছিলেন বিক্রি করার জন্য জায়গা জমি কোথায় পেলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তেমন কোন সদোত্তর দিতে পারেনি। এখন যে হোটেল করেছি সেখানে একজন পুলিশ কর্মকর্তাও অংশীদার রয়েছে মিজান দাবি করেন।